সন্তান জন্ম দেওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা একজন প্রসূতি ও নবজাতকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। প্রসব পরবর্তী এ সেবাকে চিকিৎসকরা বলে থাকেন পিএনসি। যা মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশে প্রতি একশ’ জনের মধ্যে ৬৮ জন প্রসূতি প্রসব পরবর্তী এ সেবার বাইরে রয়ে গেছেন। এতে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গাইনি চিকিৎসকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটে থাকে প্রসব পরবর্তী সময়ে। এরমধ্যে ৫৬ ভাগের মৃত্যু হয় প্রসব পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায়। অথচ প্রসব পরবর্তী সেবা গ্রহণের হার মাত্র ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রসবের পর ৬৮ শতাংশ প্রসূতি সেবার বাইরে থাকেন। অথচ সন্তান প্রসবের পূর্বে একজন মা বা তার পরিবার যে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, প্রসব পরবর্তীতে এ পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। এ কারণে মাতৃমৃত্যু রোধ অসম্ভব হয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন তারা। এ জন্য গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান প্রসবের পর সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ চিকিৎসকদের।
প্রসূতি চিকিৎসকরা বলছেন, একজন গর্ভবতী মাকে গর্ভধারণ থেকে প্রসব হওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে অন্তত চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের দ্বারস্ত হওয়া প্রয়োজন। ফলে গর্ভাবস্থায় কোন জটিল সমস্যা থাকলে সেটি সহজেই একজন চিকিৎসকের দ্বারা দূর করা সম্ভব হয়ে ওঠবে। না হয় জটিলতা তৈরি হয়ে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। একইভাবে প্রসব পরবর্তী সময়েও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ অধিক জরুরি। তাতে মাতৃমৃত্যুরোধ অনেকাংশেই কমে আসবে।
২০২২ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে হাসপাতালে এসে সন্তান প্রসব ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশ হয়েছে। এরপরও যেসব মা হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেছেন, তাঁদের মধ্যেও ২২ শতাংশ পিএনসি বা প্রসব পরবর্তী সেবা নেন না। আর যেসব মা বাড়িতে সন্তান প্রসব করেন, তাঁদের মধ্যে সেবা নেন না ৮৭ শতাংশ।
চমেক হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফাহমিদা ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রসব পরবর্তী সেবা খুবই জরুরি হলেও দেশে এটি খুব উপেক্ষিত। উদাসীনতা আর অবহেলার কারণে এ সময়ে প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনি নবজাতকের মৃত্যুও হয়। এ জন্য গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব পরবর্তী সময় পর্যন্ত পরিকল্পনা মোতাবেক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি।
মাতৃমৃত্যুর এক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাতৃমৃত্যু হারের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, খিঁচুনির কারণে ২৪ শতাংশ, পরোক্ষ কারণে ২০ শতাংশ (ডায়াবেটিস,উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি), প্রত্যক্ষ কারণে ৭ শতাংশ, গর্ভপাতে ৭ শতাংশ, বাধাগ্রস্ত প্রসবে ৩ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ৮ শতাশের মৃত্যু হয়ে থাকে।
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল এন্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুন নেসা রুনা বলেন, ‘মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ রক্তক্ষরণ ও খিচুনি। অথচ এ দুটি কারণ সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধযোগ্য। এছাড়াও গর্ভ ধারণের আগে কিংবা পরে পরিকল্পনার অভাব, চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের অনাগ্রহী কিংবা বাসা-বাড়িতে প্রসবের চেষ্টার কারণে প্রসবের সময় কিংবা প্রসব পরবর্তী সময়ের মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ কারণেই মৃত্যুরোধ কমিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে সকলকেই সচেতন হতে হবে। তাহলেই লক্ষ্যমাত্রার আগেই মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।’
পূর্বকোণ/পিআর