চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

সর্বশেষ:

সীমান্তে ফের গোলাগুলি : বাজছে যুদ্ধের দামামা

সীমান্তে ফের গোলাগুলি : বাজছে যুদ্ধের দামামা

সীমিত বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার চিন্তা ভারতের, প্রস্তুত পাকিস্তানও

মুহাম্মদ মোরশেদ আলম

২ মে, ২০২৫ | ১১:৪৮ অপরাহ্ণ

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে সশস্ত্র ব্যক্তিদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর থেকে পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। উপমহাদেশের চিরবৈরী প্রতিবেশী দেশ দুটির সম্পর্ক একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তারা প্রতিশোধমূলক হামলার নানা ছক কষছে। বাজছে যুদ্ধের দামামা। ইসলামাবাদ-নয়াদিল্লির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) সংলগ্ন এলাকায় পূর্ণমাত্রার সামরিক মহড়া চালিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ৩০ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেশটির বিভিন্ন ইউনিটে সেনা ও কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন সিয়ালকোট, নারোওয়াল, জাফরওয়াল, শাকরগড়সহ একাধিক এলাকায় সেনাবাহিনীর এই মহড়া চলছে। এতে হালকা ও ভারী আধুনিক অস্ত্র, যেমন- ট্যাংক, কামান এবং পদাতিক বাহিনীর ইউনিট অংশ নিয়েছে।

নিরাপত্তা সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই মহড়ার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- শত্রুর যেকোনো আগ্রাসনের জবাবে একটি শক্তিশালী ও সুনির্দিষ্ট বার্তা দেওয়া। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সবসময় সর্বোচ্চ প্রস্তুত রয়েছে এবং যেকোনো আক্রমণে দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত বলে তারা জানিয়েছে। এদিকে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ফের মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। বৃহস্পতিবার রাতে টানা অষ্টম দিনের মতো দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, পাকিস্তান বিনা উস্কানিতে কুপওয়ারা, বারামুলা, পুঞ্চ, নওশেরা ও আখনুর সেক্টরে ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়। এর জবাবে ভারতের সেনারা পাল্টা গুলি ছোড়ে। এর আগে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা দাবি করেন, মহড়ার আগের দিন বুধবার কিয়ানি ও মান্ডাল সেক্টরে বিনা উস্কানিতে ভারতের পক্ষ থেকে অস্ত্রের গুলি চালানো হয়। এর জবাবে তারা ভারতের একটি তল্লাশিচৌকি ধ্বংস করে দিয়েছেন।

ওদিকে, কাশ্মীর হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে সীমিতভাবে শাস্তিমূলক জবাব দিতে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) অতিক্রম না করেই দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনা করছে ভারত। সরকারি সূত্রের বরাতে টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটি (সিসিএস) পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলছেন, সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে- কখন, কীভাবে ও কোথায় আঘাত হানা হবে, তা নির্ধারণ করার জন্য তারা পূর্ণ স্বাধীনতা পাবেন। প্রতিরক্ষা সূত্রে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে এক কর্মকর্তা বলেন, শাস্তিমূলক হামলার পরিকল্পনা ও স্তরভিত্তিক প্রতিক্রিয়ার কৌশল ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে। এটা হঠাৎ করে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয় বরং সুপরিকল্পিত, বাস্তবসম্মত ও নিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া- একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। এর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত বিমান হামলার কথাও বিবেচনায় রয়েছে, যা ২০১৯ সালের বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটিতে করা বিমান হামলার মতোই কার্যকর হতে পারে। এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, তখন আমাদের কাছে রাফায়েল জেট ছিল না। এবার লক্ষ্য হতে পারে বাওয়ালপুরে জইশের সদর দপ্তর বা মুরিদকে লস্কর-ই-তৈয়বার ঘাঁটি। এই সম্ভাব্য হামলায় ব্যবহৃত হতে পারে রাফায়েল, মিরাজ-২০০০ ও সুখোই-৩০এমকেআই যুদ্ধবিমান। এগুলোর সঙ্গে থাকবে ফ্রান্সের ‘স্ক্যাল্প’ ক্রুজ মিসাইল, ইসরায়েলি ‘ক্রিস্টাল মেজ’ মিসাইল এবং ‘স্পাইস-২০০০’ নির্ভুল বোমা, যেগুলো পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে এখন প্রশ্ন এটা নয় যে ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, বরং প্রশ্ন হল ‘কবে নেওয়া হবে’।

পাকিস্তান সরকার বলেছে, ভারত আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সামরিক হামলা চালাতে পারে বলে ‘নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য’ রয়েছে তাদের কাছে। তবে পাকিস্তান ইতোমধ্যে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তারা সীমান্তে বাহিনী মোতায়েন করেছে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করেছে, ফলে ‘চমক’ দেওয়ার সুযোগ আর তেমন নেই।

এর আগে, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল রাতের মধ্যে ভারতীয় রাফায়েল যুদ্ধবিমানগুলো দখলকৃত কাশ্মীরের আকাশসীমায় ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে টহল দেয়। পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ) তাৎক্ষণিকভাবে ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলোর গতিবিধি শনাক্ত করে এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক ও কার্যকর প্রতিক্রিয়ার কারণে ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো হতচকিত হয়ে পিছু হটে। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘পাকিস্তান আগবাড়িয়ে উস্কানিমূলক কোনো পদক্ষেপ নেবে না। তবে উস্কানি দেওয়া হলে কঠোর জবাব দেওয়া হবে।’ এটি স্পষ্ট করে যে, ইসলামাবাদ যুদ্ধ চায় না, তবে প্রস্তুত রয়েছে আত্মরক্ষার জন্য। এদিকে, ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে। এই অবস্থানে একধরনের দ্বিমুখী বার্তা রয়েছে- একদিকে আত্মরক্ষা, অন্যদিকে হামলার সম্ভাব্যতা।

এদিকে, সম্প্রতি কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের ঘটনার ‘জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে’ ভারত যেন বিস্তৃত সংঘাতের পথে না যায় সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। ১ মে এক সাক্ষাৎকারে ভান্স বলেন, ‘আমাদের আশা, ভারত এই সন্ত্রাসী হামলার জবাবে এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, যেন তা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের দিকে নিয়ে না যায়। ’

এর আগে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা নিয়ে ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ফোন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। এ সময় হামলার ঘটনা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনা কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন রুবিও।

ওদিকে, দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে চীন। ১ মে লাহোরে নিযুক্ত চীনের কনসাল জেনারেল ঝাও শিরেন বলেন, সব পরিস্থিতিতে- সাফল্যের মুহূর্তে হোক বা সংকটের সময়- চীন পাকিস্তানের পাশে থাকবে। পাশাপাশি, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে তিনি সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়, বরং উভয় দেশকে শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক পথ অনুসন্ধান করতে হবে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সেন্ট্রাল পাঞ্জাব নেতৃত্বের সঙ্গে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এসব কথা বলেন তিনি। ঝাও শিরেন জোর দিয়ে বলেন, চীন পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উত্তেজনা কমাতে এবং কূটনৈতিক উপায়ে বিরোধ সমাধান করতে দেশ দুটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।

গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। এই হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করে আসছে দিল্লি। তবে পাকিস্তান বলে আসছে, ওই অভিযোগের কোনো প্রমাণ ভারত এখনো দেখাতে পারেনি। একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা নিজেদের ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ (মনে করা হয়, এই গোষ্ঠীটি লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে যুক্ত) বলে পরিচয় দেয়, তারা হামলার দায় স্বীকার করে।

ভারত ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে, পাকিস্তানিদের দেওয়া ভিসা বাতিল করেছে এবং ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। জবাবে পাকিস্তান সরকার ভারতের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে শিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে। সাধারণ ভারতীয়দের জন্য ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে সীমান্তের প্রধান প্রবেশপথটি বন্ধ করে দিয়েছে। দুই দেশই নিজেদের আকাশে অন্য দেশের উড়োজাহাজ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাছাড়া, হামলার পরে দুই দেশই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

পাকিস্তানে ভারতীয় হাইকমিশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মোট ৪০টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, ভিসা প্রদান, পারমাণবিক অস্ত্রের তালিকা বিনিময়, সীমান্ত নিরাপত্তা, পারমাণবিক পরীক্ষার ব্যাপারে আগাম সতর্কতা থেকে শুরু করে সিন্ধু পানি চুক্তি, সিমলা ও তাসখন্দ চুক্তি এবং পানি বণ্টন সম্পর্কিত লাহোর ঘোষণাপত্র।

 

কার সক্ষমতা কত :

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। তারা এখন পর্যন্ত তিনবার বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের পর ১৯৯৯ সালে কারগিলে আবারও মুখোমুখি হয় তারা। এরপর বড় কোনো যুদ্ধ না হলেও, সীমান্ত এলাকাগুলোতে মাঝেমধ্যেই উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত ২২ এপ্রিল, কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, দুই দেশ একরকম মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে- পরমাণু শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে যদি সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কার পাল্লা ভারী থাকবে? সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, যে দেশের সেনা, অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বেশি, সেই দেশই জিতবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের ফলাফল শুধু এই উপাদানগুলোর ওপর নির্ভর করে না। যদিও সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ভারত এগিয়ে, তারপরও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হলে নিশ্চিত জয় পাওয়া ভারতের জন্যও সহজ নয়।

সমরশক্তির তুলনা নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য বলছে, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারী, যেখানে পাকিস্তানের অবস্থান ১২তম। সামগ্রিক বিবেচনায় স্থলশক্তিতে ভারতের লোকবল ও সামরিক সরঞ্জাম বেশি থাকলেও এগিয়ে পাকিস্তান। এর কারণ নানাবিধ। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার-এর ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে সক্রিয় সদস্য রয়েছে ১৪ লাখ ৫০ হাজারের বেশি, যেখানে পাকিস্তানে এই সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখের কিছু বেশি। রিজার্ভ বাহিনীর দিক থেকেও ভারত এগিয়ে- দেশটির রিজার্ভ সেনার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ লাখ, বিপরীতে পাকিস্তানের রয়েছে সাড়ে ৫ লাখের মতো। সামরিক বাহিনীর আকার এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকেও ভারত বেশ এগিয়ে, যার ফলে তারা প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল বাজেট বরাদ্দ করতে পারে। ২০২৪ সালে ভারতের সামরিক বাজেট ছিল প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে পাকিস্তান ব্যয় করেছে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

পাকিস্তানের বিমান সক্ষমতার ক্ষেত্রে মোট বিমান আছে ১ হাজার ৩৯৯, যার মধ্যে যুদ্ধবিমান আছে ৩২৮টি। তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান আছে ৪৫২ টি। বিপরীতে ভারতের মোট বিমান ২ হাজার ২২৯টি এবং যুদ্ধবিমান আছে ৫১৩টি। তবে রয়টার্সের তথ্য অনুসারে ভারতের যুদ্ধবিমান আছে ৭৩০টির মতো। ভারতের এটাক হেলিকপ্টার আছে যেখানে ৮০টি, সেখানে পাকিস্তানের ৫৭টি। ভারতের ট্যাংক আছে ৪ হাজার ২০১টি, বিপরীতে পাকিস্তানের আছে ২ হাজার ৬২৭টি। ভারতের সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি আছে ১০০টি, যেখানে পাকিস্তানের আছে ৬৬২টি। ভারতের টোয়েড আর্টিলারি আছে ৩ হাজার ৯৭৫টি এবং পাকিস্তানের আছে ২ হাজার ৬২৯টি।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আনুপাতিক সক্ষমতা বিবেচনায় ভারতের প্রায় কাছাকাছি হলেও নৌশক্তিতে পাকিস্তান বেশ খানিকটা পিছিয়েই আছে। ভারতের নৌবহরে মোট নৌযান আছে ২৯৩টি- এর মধ্যে দুটি বিমানবাহী রণতরি, ১৮টি সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার ১৩টি, ফ্রিগেট ১৪টি, করভেট ১৮টি এবং টহল নৌযান ১৩৫টি। বিপরীতে পাকিস্তানের নৌবহরে মোট নৌযান আছে ১২১ টি। দেশটির কোনো বিমানবাহী রণতরি নেই, তবে ৮টি সাবমেরিন আছে। কোনো ডেস্ট্রয়ার না থাকলেও ফ্রিগেট ও করভেট আছে ৯টি করে। পাকিস্তানের টহল নৌযান আছে ৬৯টি। মাইন ওয়ারফেয়ারের ক্ষেত্রে ভারতের সক্ষমতা শূন্য, পাকিস্তানের নৌযান আছে ৩টি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব সময় লোকবল ও সরঞ্জামই একটি সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা তুলে ধরে না। মার্কিন থিংক ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনসের ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ফেলো মানজারি চ্যাটার্জি মিলার নিউজউইককে বলেন, ভারতের সামরিক বাজেট ও সক্ষমতা পাকিস্তানের চেয়ে ‘অনেক বেশি’ হলেও এটি মূল সমস্যা নয়। তিনি বলেন, ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যুদ্ধের ক্ষেত্রে উভয় দেশের সামরিক বাহিনী উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে এবং ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটাতে পারে কি না এবং এর উত্তর দ্ব্যর্থহীনভাবে হ্যাঁ।’

যুক্তরাষ্ট্রের সেলেম স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক কানিষ্কম সাতশিভম বলেন, জনসংখ্যা ও জিডিপির ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা থাকলেও দুই দেশের সামরিক শক্তি ‘ততটা ভিন্ন নয়’।

 

পারমাণবিক সক্ষমতা :

ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী। তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলে এ সক্ষমতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অগ্নি- থ্রি/ফাইভ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (পাল্লা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কিলোমিটার), মিরেজ ২ হাজার ও রাফায়েল এবং সামুদ্রিক প্রতিরক্ষায় আইএনএস আরিহান্ট। পারমাণবিক অস্ত্র আগে ব্যবহার না করার (নো ফার্স্ট ইউজ/এনএফইউ) নীতির পক্ষে ভারত। তবে এ ধরনের হামলার শিকার হলে ব্যাপক আকারে প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে দেশটি।

অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৪০ থেকে ১৫০। এদিক থেকে পাকিস্তানের সক্ষমতা ভারতের চেয়ে বেশি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে আছে শাহিন- টু/থ্রি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাত্র, এফ- ১৬ যুদ্ধবিমান, বাবর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশটি ‘ফুল- স্পেকট্রাম ডেটারেন্স’ নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী। এ নীতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটি প্রয়োজনে আগেভাগে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।

 

পরমাণু যুদ্ধ বাঁধলে কি হবে :

দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটবে বলে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক এক গবেষণায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। এর ফলে জলবায়ুর ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তাতে অনাহারে মারা যাবে আরও বহু কোটি মানুষ। এ রকম এক বিপর্যয়ের ধারণা দিতে গিয়ে গবেষণায় বলা হয়, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর এই দুটি দেশের মাঝে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। আমেরিকার রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। গবেষক অ্যালান রোবোক বলছেন, এর আগেও বেশ কয়েকবার পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমি বলতে পারব না। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে গত ৭৪ বছরে এই বোমা আর ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্বের অর্থ হচ্ছে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা যদি এসব ব্যবহার না করি, এগুলো ব্যবহারের যদি যৌক্তিক কোনও কারণ না থাকে, তাহলে এসব ধ্বংস করে ফেলা উচিত। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে জাতিসংঘে পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধে একটি চুক্তি সই হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ৩২টি দেশ এই চুক্তি অনুমোদন করেছে। ৫০টি দেশ অনুমোদন করলেই এটি কার্যকর হবে। তাই এখন বাকি বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত। গবেষকরা বলছেন, পারমাণবিক বোমা যেখানে পড়বে, শুধু সেখানকারই মানুষই নয়, পুরো বিশ্বের জন্যেই সেটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। জলবায়ু বিজ্ঞানী অ্যালান রোবোক বলছেন, পারমাণবিক বোমার ফলে আগুন লেগে যাবে, সেই আগুন থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া তৈরি হবে সেটা ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। এই ধোঁয়ার কারণে আমাদের এই গ্রহে সূর্যের আলোও ঠিক মতো এসে পৌঁছাতে পারবে না। ফলে পৃথিবী অনেক ঠাণ্ডা আর অন্ধকারময় হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ধোঁয়া যখন পৃথিবীর আরও ওপরের আবহমণ্ডলে চলে যাবে তখন সেটা সূর্যের আলোতে উত্তপ্ত হয়ে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়বে যা সেখানে স্থায়ী হবে কয়েক বছর। বৃষ্টিপাত কমে যাবে। তেজস্ক্রিয়তার ঘটনা ঘটবে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনের ওপর। ফলে যুদ্ধের পরেও অনাহারে আরো বহু মানুষের মৃত্যু হবে।

কিন্তু তারপরও কি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লাগতে পারে? পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে ভারতের নীতি হচ্ছে তারা এই অস্ত্র আগে ব্যবহার করবে না। কিন্তু তারাও এখন এই নীতি পুনর্বিবেচনার কথা বলছে। পাকিস্তান সবসময় বলেছে, এরকম অঙ্গীকার করতে তারা রাজি নয়। ফলে দুটি দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর ফলে পারমাণবিক যুদ্ধ যে কখনই ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

ভারতের কৌশলগত জোটে রয়েছে ইসরায়েল, রাশিয়া ও ফ্রান্স। অন্যদিকে পাকিস্তানের রয়েছে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। আছে সীমিত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও।

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জনবল, সামরিক ব্যয় ও প্রচলিত অন্যান্য প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের এগিয়ে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পরমাণু ও কৌশলগত অস্ত্রের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার, অপ্রতিসম যুদ্ধকৌশল ও চীনের জোরালো সমর্থন দেশটিকে এক সুবিধাজনক প্রতিরক্ষা অবস্থানে রেখেছে।

অতীতে ঐতিহাসিকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বৈরিতার লাগাম টেনে ধরার প্রধান কারিগর হিসেবে ভূমিকার রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এবারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মোদির ‘বন্ধু’ ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ভূমিকা রাখে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

তবে যুদ্ধের ফল যে কারো জন্যই সুখকর হবে না তা উভয় দেশই ভালোভাবে অনুধাবন করে। দুটি দেশই পরমাণু শক্তিধর দেশ। উভয়ের কাছেই রয়েছে বিধ্বংসী সব বোমা ও উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র। পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম এসব ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত, যা উভয় দেশের যে কোনো সীমানা পর্যন্ত অতিক্রম করে।

উভয় দেশই আরও জানে যে, বড় আকারের যুদ্ধ হলে তা তাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলবে, ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাবে এবং রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে নস্যাৎ করে দেবে। যুদ্ধ হলে কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে এবং সমগ্র অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। আর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সংঘাত পরমাণু যুদ্ধে রূপ নিলে তা সমগ্র ভূখণ্ডকে বিরাণ ভূমিতে পরিণত করবে। বড়বড় শহরগুলো পরমাণু হামলার টার্গেট হবে এবং মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। এই যুদ্ধে কেউই জিতবে না। যুদ্ধ দুটি দেশকেই পঙ্গু করে দেবে। আশপাশের অন্য দেশগুলোর ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এছাড়া, আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং উন্নয়ন উদ্যোগগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জ্বালানি ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিতে পারে। ফলে সমগ্র বিশ্ব এই যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক চাপ, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা হয়তো শেষ পর্যন্ত উভয় দেশকে সংযত রাখবে। কেননা, যুদ্ধ ধ্বংস ছাড়া কখনও শান্তি আনে না।

 

তথ্যসূত্র : রয়টার্স, এএফপি ও আল জাজিরা।

লেখক : মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন