পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার দুই সপ্তাহের মাথায় সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান।
বুধবার প্রথম প্রহরে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে হামলা চালানোর কথা বলেছে ভারত। পাকিস্তানের তরফে ছয়টি স্থানে হামলা হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে।
ইসলামাবাদ বলেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানের অন্তত ২৬ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন। আর ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাকিস্তানের গোলায় ১০ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয়েছেন ৪৮ জন।
গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারতের দাবি, তারা যে চারজনকে পেহেলগাম হামলায় সন্দেহ করছে, তাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানের নাগরিক।
ওই হামলার থেকে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটে। সীমান্ত বন্ধ করার পাশাপাশি পানি চুক্তি, বাণিজ্য স্থগিত করে প্রতিবেশী দেশ দুটি। আকাশসীমা বন্ধ করার পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়েও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে এনডিটিভি লিখেছে, অপারেশন সিঁদুর’ নামে চালানো ভারতের অভিযানে মোট ৯টি স্থাপনাকে নিশানা করা হয়। এর মধ্যে পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে জইশ-ই-মোহাম্মদের এবং মুরিদকেতে লস্কর-ই-তৈয়বার সদর দপ্তর রয়েছে।
ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ‘সন্ত্রাসবাদী কাঠামোতে’ হামলা চালিয়েছে তারা।
“যেখান থেকে ভারতের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেসব স্থাপনাই ছিল এই অভিযানের লক্ষ্য।”
বিবৃতিতে এও বলা হয়, “কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনায় হামলা হয়নি। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও হামলা পরিচালনায় ভারত যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুধবার রাতের এ অভিযানের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেন বলে এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপত্র আইএসপিআর জানিয়েছে, ভারতের ছোড়া ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছয়টি স্থানে আঘাত হেনেছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাওজা আসিফ জিও টেলিভিশনকে বলেছেন, ভারত নিজেদের আকাশসীমা থেকে পাকিস্তানের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। হামলাগুলো হয়েছে জনবহুল এলাকায়। ভারত ‘সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে’ অভিযানের যে দাবি করেছে, তা ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’।
ভারতীয় হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’বর্ণনা করে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী মঙ্গলবার রাতে বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে জবাব দেওয়া শুরু করেছে।
তিনি বলেন, তার দেশে সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়েছে পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুরের কাছে আহমেদপুর শরকিয়ায়। সেখানে একটি মসজিদ চত্বরে এক শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন। এছাড়া মুরিদকে শহর, শাকরগড় ও শিয়ালকোটের কাছাকাছি একটি গ্রামেও হামলা হয়।
আল জাজিরা লিখেছে, পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ ও কোটলিতে দুটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে এবং ১৬ ও ১৮ বছর বয়সী দুই কিশোর-কিশোরী নিহত হয়েছে।
হামলার জবাবে ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ।
রয়টার্স লিখেছে, পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ভারত শাসিত কাশ্মীরে তিন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “বিশ্বাসঘাতক শত্রু পাকিস্তানের ভেতরে পাঁচটি স্থানে কাপুরুষোচিত হামলা চালিয়েছে। এই ঘৃণ্য আগ্রাসনের শাস্তি থেকে তারা রেহাই পাবে না।”
তিনি বলেন, “বিনা উসকানিতে ভারতের এই হামলার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার পূর্ণ অধিকার পাকিস্তান সংরক্ষণ করে- এবং সেই জবাব ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
“পুরো জাতি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশে একতাবদ্ধ। আমাদের মনোবল ও সংকল্প অটুট। পাকিস্তানের সাহসী অফিসার ও সেনাদের জন্য আমাদের প্রার্থনা রইল।”
শাহবাজ শরিফ বলেন, “শত্রুকে তাদের লক্ষ্য কখনোই পূরণ করতে দেওয়া হবে না।”
ভারতের হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেন, “তারা আমাদের সহ্যসীমা অতিক্রম করেছে।”
তিনি জানিয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) জরুরি সভা ডেকেছেন। ভারতের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় করণীয় নির্ধারণে বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় এ বৈঠক হওয়ার কথা।
ভারতের সেনাবাহিনী কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে চুড়হা কমপ্লেক্সে সাদা পতাকা উত্তোলন করেছে- এমন দাবি করে আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, সাদা পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ভারত তাদের ‘পরাজয় স্বীকার’ করে নিয়েছে।
এদিকে সংঘাতের মধ্যে দুই দেশের কিছু কিছু এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জম্মু, সাম্বা, কাঠুয়া, রাজৌরি ও পুঞ্চ এলাকায় বুধবার সব স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আর পাকিস্তানে রাজধানী ইসলামাবাদ ও পাঞ্জাব প্রদেশে সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
অন্যদিকে দুই দেশেই বহু ফ্লাইট এবং কয়েকটি বিমানবন্দর বন্ধ করা হয়।
এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, স্পাইসজেটসহ ভারতের বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স মঙ্গলবার মাঝরাতের পর থেকে ভারতের কাশ্মীর এবং রাজস্থান ও পাঞ্জাবের মত সীমান্তবর্তী রাজ্যের কিছু শহরে ফ্লাইট বাতিল করে।
অপরদিকে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের খবরের তথ্য প্রচারের পর পাকিস্তান লাহোর ও করাচির প্রধান শহরগুলোর আকাশসীমা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়।
কাতারসহ বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স সাময়িকভাবে পাকিস্তানে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এমিরেটস, টার্কিশ কার্গো এবং সৌদিয়ার মত অন্য এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট ডাইভার্ট করেছে। এয়ার ফ্রান্স ও জার্মান এয়ারলাইন্স লুফথানসা জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তারা পাকিস্তানের উপর দিয়ে ফ্লাইট চালাবে না।
বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তার মুখপাত্র বলেন, “নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের সামরিক অভিযান নিয়ে মহাসচিব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তিনি উভয় দেশকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন।”
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো সামরিক সংঘাতের ভার বিশ্ব বহন করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেছেন গুতেরেস।
আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানে ভারতের হামলার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “এটা লজ্জাজনক।”
ট্রাম্প বলেন, “আমি মনে করছি অতীতের কিছু ঘটনার উপর ভিত্তি করে মানুষ জানত যে কিছু ঘটতে চলেছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে। তারা অনেক, অনেক যুগ ধরে একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে আসছে।
“সঠিক করে বলা হলে, এক শতক ধরে তারা লেগে আছে বলে মনে করতে পারেন। আশা করছি এটি দ্রুতই শেষ হবে।”
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনার বিষয়ে সতর্ক নজর রাখার কথা এক্স পোস্টে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় দূতাবাস জানিয়েছে, পাকিস্তানে আক্রমণের পর মঙ্গলবার রাতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ফোনে রুবিওকে সামরিক পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করেন।
সূত্র : বিডিনিউজ
পূর্বকোণ/এএইচ