রোকেয়া বেগম (৬২)। বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের ডোংরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। সাগর পাড়ে ঝড়ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করেই বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু ‘৯১ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় তার সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।
৩৪ বছর আগের সেই বিভীষিকাময় রাতের স্মৃতি হাতড়ে রোকেয়া বেগম বলেন, জলোচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে দুই কিলোমিটার দূরে চলে যাই। এরই মধ্যে পানির স্রোতে স্বামী ও ৫ ছেলে-মেয়ে ভেসে যায়।’ ওই রাতে স্বজনসহ ১৪ জনকে হারান তিনি। বাড়ি-ভিটা হারিয়ে আশ্রয় নেন সাধনপুরে।
‘৯১-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে রোকেয়া বেগমের মতো হাজার হাজার মানুষ স্বজন হারান। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ ও কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায়। জলোচ্ছ্বাস অভিঘাত সামাল দেয়ার মতো বাঁধ না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে বলে জানান উপকূলীয় বাসিন্দারা। এরপর থেকেই টেকসই ও শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণের দাবি ছিল উপকূলীয় মানুষের।
পাউবো ও উপকূলীয় বাসিন্দারা জানান, ২০১৫ সালের পর উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, ব্লক বসানো ও সংস্কারে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে পানির টাকা বেশির ভাগই পানিতে গেছে। বাঁশখালীতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধ তিন বছর না যেতেই দেবে যায়। বিভিন্ন স্থানে ভেঙে ঢুকছে জোয়ারের পানি। একইভাবে আনোয়ারায় ৫৭৭ কোটি ও সন্দ্বীপে ২১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধও ২-৩ বছরে ভেঙে যায়। এসব বাঁধ সংস্কারে প্রতি বর্ষায় আবার কোটি কোটি টাকা খরচের আয়োজন করে পাউবো।
বাঁশখালীর সাবেক দুই চেয়ারম্যান বলেন, বাঁশখালীতে নিম্নমানের কাজ হয়েছে। কাজ শেষ হওয়ার আগেই খানখানাবাদ, সাধনপুর, ছনুয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙন ধরেছিল। প্রতিবর্ষায় বাঁধের নতুন নতুন এলাকা ভাঙছে। সংস্কারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস রয়েছে উল্লেখ করে দুই চেয়ারম্যান বলেন, পাউবো ও ঠিকাদার অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণে নয়-ছয় করেছে। এখনো অরক্ষিত রয়েছে বেশির ভাগ এলাকা। বর্ষা আসলেই আতঙ্ক-শঙ্কায় দিন কাটান উপকূলবাসী।
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক বলেন, অনিয়ম নয়, বাজেট কম ছিল। কম টাকায় বেশি কাজ করতে হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পানি সামাল দেওয়া। তাই বাঁধ টেকসই হয়নি।
টাকা-সময় ‘খেকো’ বেড়িবাঁধ:
২০১৫ সালে বাঁশখালীতে ২০৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস করা হয়। পরবর্তীতে সময় ও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন শ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। শেষ হয়েছে ২০২৩ সালে। প্রকল্পের কাজে নিম্নমানের পাথর ও সাগরের লবণাক্ত বালু ব্যবহার এবং বাঁধ নির্মাণে বালুমিশ্রিত মাটি ব্যবহারের অভিযোগ ছিল।
কামরুল আলম নামে খানখানাবাদ এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতারা ঠিকাদারি ও উপ-ঠিকাদারি নিয়েছিল। ২-৩ বছর না যেতেই বাঁধ দেবে ভাঙন ধরেছে।
সন্দ্বীপেও তথৈবচ:
২০১৭ সালে সন্দ্বীপে ১৯৭ কোটি ৪ লাখ টাকার প্রকল্প পাস হয়। পরে অর্থ বেড়ে দাঁড়ায় ২১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকায়। সময় ও অর্থ দুটিই বেড়েছিল। সন্দ্বীপের বাসিন্দা খসরু মিয়া বলেন, দেখভালোর দায়িত্বে থাকা পাউবোর কর্মকর্তারা কালেভদ্রে সন্দ্বীপ আসতেন। মিলেমিশে বাঁধ নির্মাণে হরিলুট করেছেন।
পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৈয়দ আরশাদ আলী বলেন, এখন ৫৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। তবে আগের বাঁধের যেসব জায়গায় সমস্যা রয়েছে, সেখানে রিপেয়ার (সংস্কার) করেছি।
আনোয়ারায় ৫৭৭ কোটি টাকার প্রকল্পেও নয়-ছয়:
আনোয়ার উপকূলীয় বাঁধ সুরক্ষায় ২০১৬ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শুরু থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৮ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কয়েক দফায় ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সময়ও বেড়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত করা হয়। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭৭ কোটি টাকায়। প্রকল্পের শুরু থেকে কাজের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল এলাকাবাসী। এ অভিযোগে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে তারা।
এসব বিষয়ে পাউবো কর্মকর্তা জুলফিকার তারেক বলেন, এখন বড় বাজেটে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। আগে বাজেট কম ছিল, বাঁধ টেকসই হয়নি।
অনিয়মের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি:
২০২০ সালে বাঁশখালী, সন্দ্বীপ ও খাগড়াছড়ি জেলার প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করেছিল পাউবো। ঊচ্চ পর্যায়ের তিন সদস্যের তদন্ত টিম অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজের প্রমাণ পেয়েছিল। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঠিকাদার কাজের মান নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের চেয়ে অতিরিক্ত বিল প্রদান করা হয়েছে। নিম্নমানের তৈরি করা ব্লক বাতিল করা হয়েছে।
১৬শ কোটি টাকার প্রকল্পের মান নিয়ে সংশয়:
পটিয়ায় চলছে ১১৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প। শুরু থেকে নানা অভিযোগ রয়েছে। সন্দ্বীপে ৫৬২ কোটি টাকার প্রকল্পের ঠিকাদার আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় এখন দুচিন্তায় পড়েছে পাউবো। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সংসদ সদস্যদের পছন্দনীয় ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে এখন বেকায়দায় পড়েছে। আনোয়ারা ও বাঁশখালীর ৮৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগে মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
পূর্বকোণ/ইবনুর