কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে প্রস্তাবিত ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে স্থানীয় জনসাধারণ ও বিশিষ্টজনরা একাট্টা হয়েছেন।
শনিবার মাতারবাড়ি কে জি বিদ্যালয়ে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ গণশুনানিতে ভুক্তভোগীরা এই বিতর্কিত প্রকল্পের বিরুদ্ধে তাদের তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) এবং উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোটের (ক্লিন) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই গণশুনানিতে প্রায় চার শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা অংশ নেন। কৃষক, জেলে, চিংড়ি ও লবণ চাষীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের জীবিকা ও পরিবেশের ওপর এই প্রকল্পের সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাবের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সহ আরও বেশ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন এই গণশুনানির সহ-আয়োজক ছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক খালিদ মিসবাহুজ্জামান প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। তার সাথে সহ-বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা দায়রা জজ আদালতের এডভোকেট রাবেয়া সুলতানা, সাংবাদিক মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন ও মো. নুরন্নবী এবং মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. আলাউদ্দিন। গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, গভীর উদ্বেগ এবং চরম দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। তাদের স্পষ্ট দাবি, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে মাতারবাড়ি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় নেমে আসবে, যা হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলবে।
গণশুনানিতে স্থানীয়রা মাতারবাড়িতে ইতোমধ্যেই চলমান কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাবের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেন। মোস্তাফা নামের এক নারী অভিযোগ করেন, কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত বিষাক্ত ছাই তাদের ফসলের জমি নষ্ট করে দিচ্ছে, এমনকি লাউ গাছের ফলনও বন্ধ হয়ে গেছে।
মেজবাহ উদ্দিন নামের আরেক বাসিন্দা ক্ষোভের সাথে বলেন, এই প্রকল্পের কারণে লবণ চাষ, পান চাষ, কৃষি ও মাছ চাষের মতো ঐতিহ্যবাহী জীবিকাগুলো আজ হুমকির মুখে। কর্মসংস্থান হারানোর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের কারণে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে ২২৫ একর জমি অধিগ্রহণের ফলে বহু পরিবার তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি হারিয়েছে। সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং পরিবেশ দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
লবণ চাষীরা জানান, কয়লা প্রকল্পের কারণে জমির স্বাভাবিক ঊর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, লবণ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না, যা তাদের আয় রোজগারের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, বিতর্কিত বিদ্যুৎ-জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় ২০১৩ সালে ওরিয়ন গ্রুপকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়। দফায় দফায় সময় বাড়ানোর পরেও ওরিয়ন গ্রুপ নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলো এই প্রকল্পে বিশাল অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে, যা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমালোচনার মুখে পড়েছে। এর আগে স্থানীয়রা মানববন্ধন এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এমনকি, প্রধানমন্ত্রী বরাবর গণস্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনও পেশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক খালিদ মিসবাহুজ্জামান জোরালো কণ্ঠে গণশুনানিতে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে বলেন, অরিয়ন গ্রুপ স্থানীয় জনসাধারণের মতামত উপেক্ষা করে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সরকারের কাছ থেকে এই বিশাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন বাগিয়ে নিয়েছে। এই বিতর্কিত প্রকল্পটি যদি চালু করা হয়, তাহলে মাতারবাড়ির স্থানীয় বাসিন্দারা ব্যাপক ও অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
তিনি অবিলম্বে এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের দাবি জানান এবং সরকারের প্রতি এর বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব বায়ু বিদ্যুৎ ও সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো টেকসই উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। তার এই মন্তব্য গণশুনানিতে উপস্থিত ভুক্তভোগী ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার করে।
গণশুনানির শেষে বিচারকমণ্ডলী স্থানীয়দের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে মাতারবাড়িতে ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের পক্ষে রায় দেন। তারা বলেন, পরিবেশ ও স্থানীয় জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে এই ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত নয়। পরিবেশ, মানুষ এবং অর্থনীতির স্বার্থে এখনও এই প্রকল্প বাতিলের সুযোগ রয়েছে বলে তারা মন্তব্য করেন। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, উন্নয়নের নামে যেন তাদের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে না পড়ে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
পূর্বকোণ/এরফান/জেইউ/পারভেজ