চট্টগ্রাম রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশেষজ্ঞবিহীন চমেক শিশুক্যানসার বিভাগ : কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

১৬ মে, ২০২৪ | ৫:৫৭ অপরাহ্ণ

এই মুহূর্তে কমপক্ষে ১০-১৫ জন শিশু ক্যানসার রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেলের শিশু অনকোলজি বিভাগে শুয়ে আছে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য। এ মাসের প্রথমদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের একমাত্র শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রেজাউল করিম এর অবসর এই শিশুগুলো এবং তাদের পরিবারকে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। শিশুদের ক্যানসারের চিকিৎসা শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ ছাড়া করা মোটেই উচিত নয়। একাডেমিক হাসপাতালে সাধারণ শিশুবিশেষজ্ঞ দিয়ে শিশুক্যানসার রোগীর চিকিৎসা দেওয়া একটি গুরুতর অন্যায়।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ আছেন ৬০ জনের কাছাকাছি এবং এদের সিংহভাগই কর্মরত রাজধানী ঢাকায়। চট্টগ্রামে সরকারী পর্যায়ে প্রফেসর রেজাউল করিমই ছিলেন একমাত্র শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ। যিনি গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শিশুক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। এই বিভাগে প্রতিবছর ৩০০০ (ইনডোর ও আউটডোর মিলে) এর মতো শিশুক্যানসার রোগী চিকিৎসাসেবা পেয়ে আসছেন। প্রফেসর রেজাউল করিম সাহেব যে এই বছরই অবসরে যাবেন এই তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ বছর আগে থেকেই জানতেন। কিন্ত উনার স্থানে নতুন একজন শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো খুঁজে পান নাই অথবা খুঁজতে চেষ্টা করেন নাই। বিকল্প হিসাবে প্রফেসর রেজাউল করিমকে বিশেষ বিবেচনায় চাকুরী এক্সটেন্শন করার কথাও কেউ বিবেচনা করেন নাই।

 

বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ হাজার শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আমাদের যেহেতু জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি নাই, তাই সঠিক সংখ্যা আরো বেশী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। আমাদের দেশে শিশুক্যানসার বিভাগের যাত্রা শুরু হয়েছে মূলত ১৯৮৫ সালে ঢাকার বিএসএমএমইউ (সাবেক পিজি হাসপাতাল) হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের একটি ইউনিট হিসাবে। ১৯৯১ সালে সরকারী অনুমোদন পাওয়ার পর যাত্রা শুরু হয় শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ এবং ২০০৪ সালে ২৭টি ফ্রি বেড ও ৪টি পেয়িং বেড নিয়ে একটি পরিপূর্ণ আলাদা বিভাগ হিসাবে শিশু অনকোলজি বিভাগের কাজ পুরোদমে শুরু হয়। শিশুদের ক্যানসারের কথা চিন্তা করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৎকালীন শিশুবিশেষজ্ঞ প্রফেসর বি মাহমুদ ২০০৯ সালে শিশুক্যানসার রোগীদের জন্য স্বল্পপরিসরে আলাদাভাবে শিশুক্যানসার বিভাগ শুরু করেন। কয়েকটি বেসরকারী সংস্থ্যা যেমন সান শাইন ফাউন্ডেশন (সাফিয়া গাজী রাহমান), এ কে খান ফাউন্ডেশন এবং চিলড্রেন লিউকেমিয়া এসিস্টেন্চ এন্ড সাপোর্ট সার্ভিস (সাংবাদিক ওসমান গণি মনসুর) শিশুক্যানসার বিভাগ গঠনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশে শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ ছিলেন মোট ১০ জনের মত। ২০১৩ সালে প্রফেসর রেজাউল করিম বিএসএমএমইউ থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে একমাত্র শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসাবে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে যোগদান করেন। গত দশবছরে তিনি শিশুক্যানসার বিভাগকে একটি পরিপূর্ণ বিভাগে রূপদান করতে সমর্থ হয়েছেন।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশুক্যানসার বিভাগ হয়ে উঠে একটি আস্থার স্থান। সুদূর টেকনাফ থেকে শুর করে বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের শিশুক্যানসারে আক্রান্ত রোগী এবং এদের পরিবারের ভরসাস্থল ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল এর শিশুক্যানসার বিভাগ। কিন্তু বর্তমানে এই বিভাগে কোন শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ নাই। সচেতন নাগরিক হিসাবে এই ধরনের ইগনোরেন্স মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের। প্রফেসর রেজাউল করিমের অনুপস্থিতিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুইজন জেনারেল শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে সাময়িকভাবে শিশুক্যানসার রোগীদের দেখভাল করার দায়িত্ত্ব দিয়েছেন। অনেকটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে করানোর মতো ব্যাপার। এই দায়িত্ত্ব জেনারেল শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদেরকে একধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের আইন অনুযায়ী শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ ছাড়া শিশুক্যানসার রোগীদেরকে চিকিৎসা দেওয়ার এখতিয়ার উনাদের থাকার কথাও নয়।

 

এই পরিস্থিতিতে আমি মনে করি নতুন একজন শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞের পদায়ন না করা পর্যন্ত প্রফেসর রেজাউল করিমকে বিশেষ আদেশে কাজ করার জন্য পুনর্নিয়োগ দেয়া হোক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ত্ববান কর্মকর্তাদের মনে রাখা উচিত শিশুক্যানসার ওয়ার্ডে শুয়ে থাকা এই শিশুগুলো হতে পারতো আপনার নিজের অথবা আপনার কোন আত্মীয় অথবা বন্ধুর সন্তান। এই অসহায় ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার আপনাদেরকে কেউ দেয় নাই। চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে এই মুহূর্তে আমাদের দাবী হলো একজন শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞকে পদায়ন করা হোক।

 

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ক্রন্সউইক। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, কানাডা

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট