আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে চট্টগ্রাম অমর একুশে বইমেলা। ২০১৯ সাল থেকে নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম মাঠে সমন্বিত বইমেলার আয়োজন করে আসছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। করোনার কারণে ২০২১ সালে বইমেলা বন্ধ থাকলেও ২০২২ সাল থেকে একই মাঠে ফের শুরু হয়। তবে এবার বইমেলার স্থান নিয়ে বেকাদায় পড়ে চসিক। জিমনেশিয়াম মাঠে বইমেলা আয়োজনে বাধা দেয় জেলা প্রশাসন। নানা দর-কষাকষির পর এবার নগরীর সিআরবির শিরীষতলকে বইমেলার স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন আয়োজকরা। প্রতিদিন বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত চলবে মেলা। তবে শুক্র ও শনিবার মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। মেলায় উদ্বোধক হিসেবে থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী ব্যরিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। উদ্বোধনের পর মেলা চলবে ২মার্চ পর্যন্ত। মেলার ২২ দিনে ২২ টি থিমে আয়োজন করা হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এসব অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকবেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
গতকাল সোমবার সিআরবি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বইমেলার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে শিরীষতল মাঠ। স্টলের জন্য তৈরি করা হচ্ছে বাঁশের কাঠামো। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রস্তত করা হচ্ছে মূল মঞ্চ। উত্তর-পশ্চিম দিকে শিশুদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে চাইল্ড কর্নার। মাঠের পূর্ব প্রান্তে রাস্তার পাশেও কিছু স্টল তৈরির কথা রয়েছে, আয়োজকদের কার্যালয়, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হবে এই স্টলগুলো। তবে এখনও সেসব স্টল তৈরির কাজ শুরু হয়নি।
অংশগ্রহণকারী কমলেও বাড়ছে স্টল
জিমনেশিয়াম মাঠের চেয়ে শিরীষতল মাঠ আয়তনে ছোট হওয়ায় কিছুটা সমস্যায় পড়েছে আয়োজকরা। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের ৫১ সদস্যের সবাই স্টল বরাদ্দ পেলেও বাদ পড়েছেন ঢাকা-সিলেটের অন্তত ৫০ প্রকাশনী সংস্থা। এবার ঢাকা ও সিলেটের ১০০ প্রকাশনী মেলায় স্টল চেয়ে আবেদন করলেও বরাদ্দ দেওয়া হবে ৫০ সংস্থাকে।
বইমেলা আয়োজক কমিটি সূত্র জানায়, এবার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মিলিয়ে মোট ১০১ টি প্রকাশনী সংস্থা মেলায় অংশগ্রহণের অনুমতি পাচ্ছে। এরমধ্যে ৩৭ টি প্রকাশনী আবেদনের ভিত্তিতে ডাবল স্টল ও বাকিরা সিঙ্গেল স্টল বরাদ্দ পাবেন। এছাড়া মূল মাঠের বাইরে পূর্বদিকে রাস্তার পাশে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, চসিক, রেলওয়েসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে আরও কিছু স্টল, সব মিলিয়ে এবার মেলায় স্টল থাকবে ১৬০ টি।
আজ মঙ্গলবার প্রকাশকদের স্টল বুঝিয়ে দেবে চসিক। এরপর লটারির মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনীকে বরাদ্দ দেওয়া হবে এসব স্টল। তারপরই স্টল সাজানোর কাজ শুরু করবে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনীগুলো।
গত বছর (২০২৩ সাল) সারাদেশ থেকে ১০৮টি প্রকাশনীকে ১৪০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এবার সেই তুলনায় প্রকাশনী সংস্থা কমলেও বেড়েছে স্টল।
মেলায় নতুন প্রকাশনী ১২, নতুন বই হাজারটি
এবার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেলায় প্রথমবারের মত অংশগ্রহণ করছে ১২টি প্রকাশনী। সব প্রকাশনী মিলে নতুন বই আসছে হাজারের মত। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলী প্রয়াস বলেন, এবার চট্টগ্রাম বই মেলায় আনুমানিক ১ হাজার নতুন বই আসবে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের প্রকাশনী থেকে আসবে প্রায় একশ’ লেখকের তিন শতাধিক নতুন বই। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার লেখকের ২০ হাজার বই থাকবে এবার।
যা যা থাকছে মেলায়
এবারের মেলায় মাঠের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে থাকবে শিশুদের জন্য আলাদা জোন। সেখানে ৫-৬টি রাইডের ব্যবস্থাও রাখা হবে। পাশেই থাকবে স্বজনদের বসার জায়গা। আর শিশুজোনে থাকবে শিশুদের বইয়েরা স্টল। এর পূর্ব পাশে থাকবে লেখক চত্বর। সেখানেই হবে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। পাশেই তরুণদের জন্য থাকবে সেলফি জোন ও বঙ্গবন্ধু কর্নার। মেলায় ছয়টি পৃথক স্থানে থাকবে ফুডকোর্টও।
মেলার মাঠে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে দর্শনার্থীদের। যদিও ধূমপায়ীদের জন্য রাখা হবে আলাদা স্মোকিং জোন। এ ছাড়াও দর্শনার্থীদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে শিরীষতলা এলাকায় রেলওয়ের তিনটি শৌচাগার। এর বাইরেও থাকবে ছয়টি ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার।
প্রস্ততি নিয়ে প্রকাশকদের অসন্তোষ
এবারের বই মেলার প্রস্ততি নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রকাশকরা। তাদের দাবি, বইমেলার স্থান পরিবর্তন ও সময়ের ধারাবহিকতা না থাকায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন তারা। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মো. সাহাব উদ্দিন হাসান বাবু বলেন, গেল কয়েক বছর জিমনেশিয়াম মাঠে বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় সেখানেই বইমেলা হচ্ছে এমন একটা ধারণা বইপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। এবার স্থান পরিবর্তন হওয়ায় কাক্সিক্ষত পাঠক পেতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া বইমেলার সময়টাও প্রতিবছর পরিবর্তন হচ্ছে। তাই প্রচারণায় বেশি করে জোর দেওয়া প্রয়োজন। আমরা মতবিনিময় সভায় চসিককে এটা জানিয়েছি। গতকাল থেকে তারা একটা পিকআপ ভ্যান দিয়ে নগরীতে প্রচারণা শুরু করেছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
তিনি আরও বলেন, বইমেলার সময় বৃষ্টি হতে পারে। তখন অনেক বই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এখানে পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থাও খুবই দুর্বল। এটাও একটা সমস্যার কারণ হতে পারে। তাছাড়া নিচে ইট না দিয়ে প্লাস্টিক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটার কারণেও বৃষ্টি হলে সবাই সমস্যায় পড়তে পারে।
বইমেলাকেন্দ্রিক পরিবহনের দাবি
নগরীতে সরাসরি সিআরবিকেন্দ্রিক কোনো গণপরিবহন নেই। তাই বইমেলা চলাকালীন সময়ে পাঠকদের সুবিধার্থে সিআরবিকেন্দ্রিক একটি গণপরিবহন চালুর দাবি জানিয়েছেন প্রকাশকরা। সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলী প্রয়াস বলেন, আগে জিমনেসিয়ামে মেলা হত, সেখানে সরাসরি গণপরিবহন আছে, পাঠকরা সহজে মেলায় যেতে পেরেছে। কিন্তু সিআরবিকেন্দ্রিক কোনো গণপরিবহন নেই, এতে পাঠকরা কিছুটা সমস্যায় পড়তে পারেন। তাই কাজির দেউড়ি থেকে দেওয়ানহাট হয়ে সিআরবি পর্যন্ত মেলা চলাকালীন সময়ে একটি বাস চালু করা যেতে পারে। আমরা এটা মতবিনিময় সভায় জানিয়েছি, এখন দেখা যাক কতদূর কী হয়।
থাকছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ভ্রাম্যমাণ আদালতও
সিআরবি এলাকায় কিছু অপরাধী চক্রের আনাগোনা থাকায় এবারের মেলায় রাখা হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মেলা বাস্তবায়ন কমিটি জানায়, নিরাপত্তার জন্য মূল মাঠের চারদিকে টিনের বেড়া দেওয়া হবে। তাছাড়া মেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্বে থাকবেন। পাশাপাশি রেলওয়ে ও চসিকের নিরাপত্তাকর্মীরাও মেলার নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবেন।
স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুৃৃ বিরোধী, ধর্মীয় উগ্রতাবাদ ছড়ায় এমন কিংবা কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করে এমন কোনো বই যেন মেলায় রাখা না যায় তা তদারকি করতে চসিকের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে থাকবে।
প্রকাশকদের অভিযোগ সমাধানের আশ্বাস
দুর্বল পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা, মেলার মাঠে ইট দেওয়া, মেলাকেন্দ্রিক গণপরিবহনের ব্যবস্থা ও প্রচারণা বৃদ্ধির বিষয়ে বইমেলার সমন্বয়ক আশেকে রসুল টিপু বলেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে মতবিনিময় সভায় কথা হয়েছে। তবে বললেই তো সবকিছু হয় না। মাঠে ইট দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, গতবার আমরা ইট দিয়ে দেখেছি, এবার দেখি কী হয়। গণপরিবহন নিয়ে বলেন নতুন জায়গায় নতুন বাস্তবতায় মেলা হচ্ছে, দেখা যাক। এটা তো সমাধান করতে হবে। মেলার মাঠের পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থাও উন্নত করা হবে বলে জানান তিনি।
করোনার পর দাম বেড়েছে বইয়ের
করোনা পরবর্তী মূল্য বৃদ্ধির পর এখনও না কমায় বই প্রকাশে খরচ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। চট্টগ্রাম বইমেলায় অংশগ্রহণকারী একাধিক প্রকাশক জানান, করোনার আগে ৮০ জিএসএম কাগজের দাম ছিল ১৮শ টাকা, এখন তা সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হয়। তার প্রভাব পড়েছে বইয়ে। আগে তিন ফর্মার একটি বই ১২০ টা বিক্রি হলে এখন সেটা ১৮০ থেকে ২শ টাকা বিক্রি করতে হয়। তাতে বই বিক্রি কমছে বলেও জানান তারা।
পূর্বকোণ/পিআর