চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী প্রধানত দুটি সংস্থা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ দুটি সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের অদূরদর্শিতা এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে চট্টগ্রামবাসীর এই দুর্ভোগ। এর অন্যতম প্রমাণ বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার সংলগ্ন খালটি যা এখন নালায় পরিণত হয়েছে। বহদ্দারহাট কাঁচা বাজারের মুখে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই নালার উপর চার তলা একটি নিজস্ব ভবন তৈরি করে। ফলে প্রায় ৩৫ ফুট প্রস্থের এই খালটি ৪ ফুট প্রস্থের নালায় পরিণত হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মতো একটি সেবা সংস্থা কর্তৃক এই অবৈধ নির্মাণের ফলে বহদ্দারহাট এলাকার অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের সাথে স্বাস্থ্যগত, আর্থিক, মানসিক ও সামাজিক দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছে।
কর্পোরেশনের জলবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের বিশেষ পরামর্শক শাহরিয়ার খালেদ চমৎকার কিছু তথ্য দিয়েছেন। তার মতে বদ্দারহাট কাঁচা বাজার সংলগ্ন এই ড্রেনটি হচ্ছে মূল চাক্তাই খাল। এই চাক্তাই খাল দিয়ে এক সময় গদী নৌকা শহর থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে মির্জা খাল, খন্দকিয়া এবং কৃষ্ণ খালী হয়ে হালদা নদীতে চলাচল করত। কালের পরিক্রমায় এই খাল এখন সংকুচিত হয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। সিএস জরিপ অনুযায়ী এ খালের প্রশস্ততা প্রায় ৩৫ ফুট।
এই পুরাতন চাক্তাই খালে সরকারি সংস্থার এই অবৈধ ভবন নির্মাণের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষ হাজি চানমিয়া সড়কের পাশের খালের অবশিষ্ট অংশ দখল করে দোকান নির্মাণ করে। যার ফলে বহদ্দারহাট এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতার কারণে অসহনীয় দুর্ভোগ, আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে।
মুরাদপুরের পরে শোলকবহর থেকে বহদ্দারহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস পর্যন্ত খালের উপর প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ দোকান ও মার্কেট নির্মাণ করে অবৈধভাবে দখল করে রাখা হয়েছিল। এরকম হিজরা খাল, চাক্তাই খাল, মির্জা খাল, মহেশখালসহ প্রায় খালে অনেক স্থাপনা রয়েছে। ড্রেনের উপর এই অবৈধ দখল এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। আমরা বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ব্যানারে গত ২০২৩ সালের জুন মাসে একটি সেমিনার আয়োজন করি। এই সেমিনারে বদ্দারহাট কাঁচা বাজারের মুখে পুরাতন চাক্তাই খালের উপর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অফিস নির্মাণের বিষয়টি সচিত্র উপস্থাপন করি। আরো বিভিন্ন ফোরামেও চট্টগ্রাম জলবদ্ধতার কারণ হিসেবে এই তথ্য উপস্থাপন করে আসছি।
তবে আশার কথা বর্তমান প্রশাসন এই জলবদ্ধতা নিরসনে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে, যার প্রমাণ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বদ্দারহাট কাঁচা বাজারের মুখের চার তলা নিজস্ব ভবনটি ইতোমধ্যেই ভেঙে ফেলেছে। শোলকবহর থেকে বহদ্দারহাট মোড় পর্যন্ত অবৈধভাবে নির্মিত অনেকগুলো মার্কেট ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলেছে।
এখন আমার প্রশ্ন, সরাসরি খালের উপর এই ভবন নির্মাণ নিশ্চয়ই কোন মেয়রের সময় হয়েছে! নিশ্চয়ই তখনকার নগর ভবনের প্রশাসনিক নিয়ম মেনে এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে! নিশ্চয়ই এই ভবন নির্মাণে সিডিএ-র কোন ইঞ্জিনিয়ার এবং নগর পরিকল্পনাবিদের অনুমোদন রয়েছে! সেই প্রশাসন শুধুমাত্র নিজেরা খাল দখল করেনি অন্যদেরও দখল করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।
এখন আমার দাবি বহদ্দারহাট এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষের আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার দায়ে এই ভবন নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্টদের কেন শাস্তির আওতায় আনা হবে না? কেন সরকারি অর্থ অপচয়ের অভিযোগ আনা হবে না? কেন অবৈধ দখলদারদের তালিকা জন সম্মুখে প্রকাশ করা হবে না? তাহলে ভবিষ্যতে অন্তত কোন রাজনীতিবিদ বা অবৈধ দখলদার এই ধরনের কাজ করতে নিরুৎসাহিত হবে।
লেখক: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সংগ্রহ: ফেসবুক ওয়াল থেকে
পূর্বকোণ/জেইউ