চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর, ২০২৪

ওরা খাদ্যের ‘আদু ভাই’

চট্টগ্রাম খাদ্য অধিদপ্তর

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৯ অক্টোবর, ২০২৪ | ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

তিলক চৌধুরী। পদবি খাদ্য বিভাগের ডাটা এট্রি কন্ট্রোল অপারেটর। পদায়ন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের টেন্ডার ও বিল শাখায়। ২০০৭ সালের ৮ এপ্রিল থেকে এক চেয়ারেই কাজ করছেন তিনি।

 

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামের টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ঠিকাদার নিয়োগের ফাইলপত্র চালাচালির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে আসছেন তিনি। সেই হিসেবে তিলকের কদর তোলায় তোলায়। তিলক চৌধুরী বললেন, ‘ভাগ্য খারাপ। চাকরিতে যোগদানের পর ১৮ বছর ধরে পদোন্নতি নেই। এক চেয়ারেই বসে আছি।’

 

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের আরেক অনুঘটক হচ্ছেন মো. সেলিম উদ্দিন। উপ-খাদ্য পরিদর্শক পদের এই কর্মকর্তা কাজ করেন বিল ও টেন্ডার শাখায়। খাদ্য বিভাগের ডিলার, মিলার ও ঠিকাদারদের সঙ্গেই তার কাজ কারবার। গুরুত্বপূর্ণ সবধরনের ফাইলপত্র চালাচালি হয় তার হাত দিয়ে। পদোন্নতি পেয়ে উপ-পরিদর্শক হওয়ার পরও কাজ করে আসছেন পিয়নের। কী মধু আছে সেই চেয়ারে? সেলিম বললেন, ‘২০১৭ সাল থেকে আছি। পদোন্নতি না হওয়ায় এক চেয়ারেই কাজ করতে হচ্ছে। তবে মাঝখানে ওএমএস কর্মসূচিতেও সংযুক্ত ছিলাম।’

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু তিলক ও সেলিম নন, খাদ্য বিভাগের আঞ্চলিক ও জেলা কার্যালয়, খাদ্য পরিচালন ও সঞ্চালন এবং হালিশহর-দেওয়ানহাট সিএসডি খাদ্য গুদামসহ বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এক চেয়ারে খুঁটি গেড়ে আছেন ১০-১৫ বছর ধরে। দুয়েকজন আবার ১৮-২০ বছরও একই চেয়ারে কাজ করে আসছেন। অনেকেই ঘুরেফিরে নামকাওয়াস্তে বদলি ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাকরির পুরো মেয়াদকাল শেষ করে আসছেন চট্টগ্রাম খাদ্য বিভাগে। খাদ্য চেয়ারগুলোতে পদোন্নতির পরও একই চেয়ার ধরে রেখেছেন ।

 

খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, লোভনীয় পদে কয়েকজন কর্মচারী বছরের পর বছর একই চেয়ার আঁকড়ে থাকেন। কারণ এসব কাজের নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতি। বড় কর্তাদের কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বলে নড়চড় হয় না কর্মচারীদের। এ বিষয়ে কথা হয় খাদ্য বিভাগের ডিলার, মিলার ও ঠিকাদার মিলের অন্তত ১০ জনের সঙ্গে। দুই ময়দার মিল মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিলের তালিকাভুক্তি চুক্তি থেকে শুরু করে গম বরাদ্দ এবং আটার চাহিদাপত্র সব টেবিলে কমিশন গুনতে হয়। এমনকি বন্ধ মিলের নামেও গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। টাকা দিলেই সব অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আঞ্চলিক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, হালিশহর ও দেওয়ানহাট খাদ্য গুদামসহ বিভিন্ন দপ্তরে এ ধরনের আদু ভাইয়েরা দীর্ঘদিন ধরে পাকাপোক্ত করে রেখেছেন তাদের চেয়ার। চট্টগ্রামে অন্তত ১০-১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে টাকার খনি খ্যাত চেয়ারগুলো আঁকড়ে আছেন।

 

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে খাদ্যশস্য বরাদ্দ শাখায় জানে আলম ২০০৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মরত ছিলেন। তবে সম্প্রতি তিনি হালিশহর খাদ্য গুদামে বদলি হয়েছেন। ঠিকাদারদের পরিবহন কর্মসূচি বরাদ্দ নীতিমালা ছিল তার হাতের মুঠোয়। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক পদে ২০০৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মরত ছিলেন সুশান্ত মিত্র। তাকে কৌশলে একই শাখায় বদলি করা হয়। নামে বদলি করা হলেও চেয়ার কিন্তু একই রয়েছে।

 

হালিশহর সিএসডি খাদ্য গুদামে ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ থেকে আছেন নজরুল ইসলাম। আর তার স্ত্রী শারমিন আকতার শিউলি একই গুদামে আছেন ২০১০ সালের ৪ জুলাই থেকে। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার কোয়ার্টারে থাকেন নজরুল দম্পত্তি। নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে হালিশহর খাদ্য গুদামে আছি। আশা করছি, পদোন্নতি হবে।’

 

খাদ্য বিভাগের খাদ্য পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে খাদ্যশস্য কর্মসূচি বিভাগে জাবেদুল আলম আছেন ২০১৪ সালের ৭ মে থেকে। পরিবহন কর্মসূচি বণ্টন করেন তিনি। একাধিক ঠিকাদার জানান, জাবেদকে টাকা দিলেই কর্মসূচি বণ্টন ওলটপালট করা যায়। গত ২ জুলাই একই কর্মস্থলে তিন বছরের অধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এতে বলা হয়েছে, খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি/পদায়ন নীতিমালা-২০১৯ (সংশোধিত ২০২২) বিধি-বিধানের ২ (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, একই কর্মস্থলে চাকরির কার্যকাল দুই বছর হলে সাধারণত বদলিযোগ্য হবেন। একই কর্মস্থলে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন বছরের অধিক নিয়োজিত রাখা যাবে না।

 

কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের সংস্থাপন শাখার মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত রয়েছেন। যা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি/পদায়ন নীতিমালা-২০১৯ (সংশোধিত ২০২২) এর পরিপন্থী বলা হয়েছে। একই কর্মস্থলে তিন বছরের অধিক কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাত কর্মদিবসের মধ্যে বদলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এই বদলিতেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি।

 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম কায়সার আলী বলেন, কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে। এই ধরনের আরও থাকলে বদলি করা হবে। তবে অনেকক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের অভাবে অনেককে বদলি করা যায় না।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট