প্রতি বর্ষপূর্তিতে দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকা ব্যতিক্রমী কিছু আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করে থাকি। সবচেয়ে বেশি যেটা সাড়া ফেলেছিল, সেটা হল কর্ণফুলী নদীর উৎসস্থল আবিষ্কার। যেটির জন্য পূর্বকোণ টিম সরেজমিনে লুসাই পাহাড় পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। সেই বিষয়টি নিয়ে পূর্বকোণে ছয়দিনের সাপ্লিমেন্ট প্রকাশ করেছিল। ওই সংখ্যাগুলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল। এরপর আমরা চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেছি। চট্টগ্রামের সম্ভাবনা এবং এর চ্যালেঞ্জসমূহ অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। মোটামুটি ১০-১৫ বছর ধরে এই ধরনের কাজ চলছে। এবারের পরিকল্পনা হচ্ছে পুরো চট্টগ্রাম শহরকে নিয়ে। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মানুষের অনেক আক্ষেপ ও ক্ষোভ আছে। আজ থেকে প্রায় ১৬-১৭ বছর আগে ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম’ নামে একটা ফোরাম গঠিত হয়েছিল। যেখানে নগর পরিকল্পনাবিদ থেকে শুরু করে অনেক বিজ্ঞ লোক রয়েছেন। সকলে মিলে অনেক চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন সময় আমরা তাদের বক্তব্য ছেপেছি। তারা অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছেন। এরপরও পরিকল্পিত তথা গোছালো চট্টগ্রাম সেটা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে চট্টগ্রাম দিনদিন পিছিয়ে যাচ্ছে। সেই চিন্তা থেকেই আমরা মাস্টার প্ল্যানের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। মাস্টার প্ল্যানের এখন তৃতীয় পর্ষদে কাজ চলছে। তাদের সাফল্যের অবস্থাটা কী? তারা যদি সফল হয়ে থাকে, আজকের জলাবদ্ধতার সমাধান কেন হয়নি? অপরিকল্পিত নগরায়ন কেন? চট্টগ্রামের এই যে একটা অবস্থা, দিনকে দিন হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। মনে হল এই মাস্টার প্ল্যান নিয়ে আমরা কাজ করতে পারি। মাস্টার প্ল্যান নিয়ে যারা জড়িত ছিল, স্বয়ং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) তারাও এটা নিয়ে অসন্তুষ্ট। তারাও আসলে পারছে না একটা গোছানো চট্টগ্রাম গড়তে। তারপর আমরা চিন্তা করলাম যে, অবকাঠামোগত দিক থেকে ভাবলে হবে না। সামগ্রিক বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। তখন আমরা বিভিন্ন খাতকে চিহ্নিত করি।
অবকাঠামো একটা দিক, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কেমন সেই দিকটাতে আমরা কতটুকু মনোযোগ দিচ্ছি, শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যে কতটা শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ রয়েছে, এভাবেই আমরা পয়েন্ট টু পয়েন্ট করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। আজকে যারা মানুষ গড়ার কারিগরÑ অভিভাবক, শিক্ষকবৃন্দ পাশাপাশি যারা শিক্ষা প্রশাসনের সাথে জড়িত, সবাই আজকে এক টেবিলে আলোচনা করবেন চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। আজকের আলোচনা পত্রিকায় তুলে ধরার মাধ্যমে নীতি-নির্ধারকদের কাছে তথ্যগুলো পাঠাতে পারব। অন্তত সমস্যাগুলো চিহ্নিত হলে সমাধানের পথে যাওয়া সহজ হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে তুমুল সমালোচনা ও গুজব ছড়িয়েছে। পরবর্তীতে দেখা গেল আসামের একটা ভিডিও নিয়ে বাংলাদেশের ভিডিও বলে ছড়ানো হয়েছে। ফ্যাক্ট চেক যারা করেন, তারা সত্য বিষয়টি আমাদের সামনে তুলে এনেছেন। নতুন কারিকুলাম নিয়ে প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে যদি বলেন, আমরা ফেসবুকে যে চিত্রটা দেখি আসলে বাস্তবতাটা কি এবং কেন আমরা এটাকে গ্রহণ করতে পারছি না। আমি একজন উদ্বিগ্ন অভিভাবককে চিনি, তিনি যখন কথা বলেন তখন তার চোখে পানি চলে আসে। আমাদের ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা বাদ দিয়ে এখন আলুভর্তা, রান্নার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তারা পড়ালেখার ধারেকাছেও নেই। পরীক্ষা হলে বসলে এক্সট্রা কারিকুলাম বলতে যেটা বুঝি, ওটা পারলে মোটামুটি পাস। এ রকম একটা ব্যাপার। ছেলেমেয়েদের মগজধোলাই হয়ে যাচ্ছে। আসলে এটার জন্য আমরা কতটা দায়ী। বাস্তবতা কতটুকু। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেন নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আজ থেকে ১০-১২ বছর আগে কিছু কিছু জায়গায় দেখা যেত প্রাথমিকে মোটামুটি ওভাবে ছেলেমেয়ে নাই। আবার কিছু কিছু জায়গায় বসার জায়গা নাই। তারা বাসাবাড়ি থেকে মাদুর এনে বাইরে বসে পড়ত। এই প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সরকারের যে মনোযোগ, তার প্রেক্ষিতে যদি আসন সংকট হয় তাহলে এই আসন সংকট নিরসনে সম্প্রসারণ অথবা ডাবল শিফট করার মত ব্যবস্থা আছে কি না। শহরে যদি এই অবস্থা হয়, জানি না গ্রামের চিত্রটা কি। শহরে কেজি স্কুলগুলোতে শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছিল। করোনার সময় ১২ শতাধিক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো আবার পুনরায় ফিরে এসেছে কি না। এসব প্রতিষ্ঠানের মান কেমন। অনেকসময় বলতে শুনি, এরা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। যেটি ওই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক ধরনের হেয় করার মতো। এমন কেন হচ্ছে? শিক্ষার মান কেমন বা শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রশাসনের ভূমিকা কি, তদারকি-নজরদারি কেমন, কেজি স্কুল পাশাপাশি প্রাইভেট স্কুলের বিষয়গুলো তুলে ধরা উচিত। পাশাপাশি মাধ্যমিক স্কুলগুলোর শিক্ষার যে অবস্থা! একটা সময় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চাহিদাসম্পন্ন স্কুলে ভর্তি করানো হতো। করোনার পর থেকে লটারি শুরু হয়েছে। লটারি করতে গিয়ে যেটা হয়েছে, ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাসই করে না। তাদেরকে পরবর্তীতে কীভাবে পাস করানো হয় জানা নেই। তারা যেকোনভাবে পাস করে আসে। আগে যে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নেয়া হতো, ভালো ছেলেগুলো ভালো জায়গায় যেতে পারত। এখন তা পারছে না। লটারি পদ্ধতি ভালো হলো না মন্দ হলো, এই বিষয় মাঝেমধ্যে ভাবায়। যেমন অনেক স্কুল মোটামুটি ভালো মানসম্পন্ন। তারা ছাত্র পেত না। অথচ বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশনের স্কুলগুলোর বড় ভূমিকা আছে। একটা সময় তারা বেতন দিতে পারত না, প্রতিষ্ঠান চালাতে পারত না।
প্রাইমারি পর্যায় শেষ করে শিক্ষার্থীরা মোটামুটি চট্টগ্রামের ভালো ভালো স্কুলে পড়তে চায়। চট্টগ্রামের সরকারি মোটামুটি ৫-৬টি স্কুল চাহিদাসম্পন্ন। কেন সিটি কর্পোরেশনের স্কুলগুলো সে ধরনের চাহিদার জায়গায় যেতে পারছে না। এই সমস্যাগুলো তুলে আনা দরকার। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেসরকারি মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। নর্থ সাউথের একজনের সাথে কথা বলে জানতে পারি, সেখানে যত ছাত্রছাত্রী পড়ে, প্রায় অর্ধেক চট্টগ্রামের। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও চট্টগ্রাম থেকে শিক্ষার্থী গিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে বড় অংকের টাকা দিয়ে ঢাকায় পড়াশোনা করতে হয়। পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার খরচ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে অনেককে বাধ্য হয়ে যেতেই হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, নর্থ সাউথ বা ব্র্যাকের মত বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে কেন হচ্ছে না। চট্টগ্রামে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে, তারা যদি ওই ধরনের মান দিতে পারত, তাহলে এত কষ্ট করে বাইরে গিয়ে যে খরচ, তা অনেকাংশে কমে যেত। চট্টগ্রামে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান করতে চাইলে কি কি মান অর্জন করতে হবে, সে বিষয়টি তুলে আনা। এই বিষয়গুলো আলোচনায় আসলে বর্ষপূর্তি সংখ্যাটা অনেক সমৃদ্ধ হবে। প্রকারান্তরে চট্টগ্রাম উপকৃত হবে।
পূর্বকোণ/পিআর