বড় ধরনের সংকটে পড়েছে হালদা নদী। তামাকের বিষ এবং অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে নদীটি এখন অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় পড়েছে। নদীর উজানে খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যাছোলা ও বাটনাতলি ইউনিয়নের বিশাল এলাকাজুড়ে এ সংকট তৈরি হয়েছে। মূলত প্রশাসনের নিরবতার সুযোগে এ দুই ইউনিয়নের অসাধু কিছু ব্যক্তির কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে হালদা নদীতে এ ধ্বংসলীলা চলে আসছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হালদা নদীর উৎপত্তিস্থল রামগড়ের পাতাছড়া ইউনিয়ন থেকে আনুমানিক ১৫ কিলোমিটার দূরে মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যাছোলা ও বাটনাতলি ইউনিয়নের বিশাল এলাকাজুড়ে করা হয়েছে বিপুল পরিমাণের তামাক চাষ। অভিযোগ উঠেছে -স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে কতিপয় তামাক কোম্পানি। তামাক কোম্পানিগুলো প্রতি ৪০ শতক জমিতে তামাক চাষের জন্য কৃষককে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা করে দিচ্ছে। তাতে অধিক টাকার আশায় কৃষকরা অন্যান্য সবজি চাষ বাদ দিয়ে তামাকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
স্থানীয় তামাক চাষী তাহেরা বেগম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, এ বছর তিনি ৪০ শতক জমিতে তামাকের চাষ করেছেন। একটি তামাক কোম্পানি তাকে ইতোমধ্যে দুই লাখ টাকা দিয়েছে। কিছুদিন পরে তাকে আরো টাকা দিবে। বিনিময়ে তারা তামাকগুলো নিয়ে যাবে। আর্থিকভাবে তুলনামূলক বেশি লাভ পাওয়ায় তার মতো আরো অনেকে তামাক চাষে নামছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয়রা জানায়, মানিকছড়ির যোগ্যাছোলা ইউনিয়নের কালাপানি, যোগ্যাছোলা ও আসাদতলি এবং বাটনাতলি ইউনিয়নের গোরখানা, ছদুরখীল ও তুলাবিলের প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় হালদা নদীর পানির সাহায্যে দুই পাড়ে একসময় ধান ও সবজির বাম্পার ফলন হতো। এ এলাকার সারি সারি পাহাড় ছিল সবুজে ভরপুর। শত-সহস্র পাখির কলকাকলিতে মুখর ছিল এ জনপদ। কিন্তু এক যুগের ব্যবধানে এখন বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে যোগ্যাছোলা ও বাটনাতলি ইউনিয়নের বিশাল এ জনপদ। জনপদটি প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদার উজানে হওয়ায় শঙ্কিত করে তুলেছে হালদা সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তামাকের বিষাক্ত ছোবলে সবুজ জনপদটি এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তামাকের বিষে দূষিত হচ্ছে হালদার স্বচ্ছ পানি, পোড়াতে উজাড় করা হচ্ছে বন, হ্রাস পেয়েছে জমির উর্বরা শক্তি আর তামাক চাষে শিশুশ্রমের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে শিশুরা। অভিযোগ ওঠেছে, মানিকছড়িতে তামাকের বিশাল আগ্রাসনে জড়িত টোবাকো কোম্পানি। চাষীদের আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে তারা তামাকের ভয়াবহতা বাড়াচ্ছে।
তামাক চাষীরা জানান, হালদার পানি ব্যবহারের সুবিধার্থে নদীর দুই ধারে প্রায় বিশাল এলাকাজুড়ে বর্তমানে শতাধিক হেক্টর জমিতে তামাকের চাষাবাদ হচ্ছে। তাতে জড়িত অর্ধ শতাধিক চাষী। এর আগে তামাক চাষের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। ধীরে ধীরে এ চাষের ভয়াবহতা বাড়ার কারণে চাষীদের বিকল্প পথে আনতে ২০১৮ সালে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠিত পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)। তাতে বিগত কয়েক বছর তামাকের চাষ আশানুরূপ কমলেও আইডিএফ’র কার্যক্রম বন্ধের পর বর্তমানে তা আবারো ভয়াবহতা বেড়ে গেছে।
এদিকে বালি খেকোদের আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত হালদা। নদীর উজানে প্রায় দুই শত পয়েন্ট থেকে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে প্রতিদিন তোলা হচ্ছে কমপক্ষে দুইশ’ ট্রাক বালি। তাতে মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যাছোলা ও বাটনাতলি ইউনিয়নের বিশাল এলাকায় হালদা নদীর দুই পাড় ভেঙে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে। নদীতে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। ভাঙনের কারণে উজান থেকে বালি নেমে ভরাট হচ্ছে ভাটি অঞ্চল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বালু খেকোদের বিরামহীন ধ্বংসযজ্ঞ চলে এলেও নীরব প্রশাসন।
এদিকে, স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় মানিকছড়ি এলাকায় প্রতিদিন হালদা নদী থেকে অবৈধভাবে শতশত ট্রাক বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। সারাবছরই হালদা পাড়ে এ ধ্বংসযজ্ঞ চলে আসলেও প্রতিকারে এগিয়ে আসছে না কেউই। ফলে পাড় ভেঙে বর্ষা মওসুমে নদীতে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। ভারী ট্রাক চলাচলের কারণে অনেকটা বিধ্বস্ত গ্রামীণ সড়কসমূহ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কোঅর্ডিনেটর প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, হালদা নদীতে ২০১৬ সালে ব্রুড মাছের ডিম না ছাড়ার পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয় মানিকছড়ি এলাকায় হালদার তীরে ব্যাপক হারে তামাক চাষকে। ২০১৭ সাল থেকে আইডিএফ এবং পিকেএসএফ এর সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে তামাক চাষ বন্ধ করতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০২১-২২ সালের দিকে এখানকার প্রায় ৯৯% তামাক চাষীদের তাদের মূল ধারার কৃষিকাজে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এই বিষয়টি তামাক কোম্পানিগুলো মেনে নিতে পারেনি। ২০২৩ সাল থেকে তামাক কোম্পানিগুলো যৌথভাবে এই এলাকার তামাক চাষীদের প্রণোদনা প্রায় চারগুণ বাড়িয়ে দিয়ে আবার তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। তখন থেকে আবার কিছু লোভী কৃষক তামাক চাষে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রায় ২০% কৃষক তামাক চাষে সম্পৃক্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে হালদা নদীর হেরিটেজ গেজেটে হালদা বেসিনে তামাক চাষ বন্ধে সংশোধনী আনার জন্য প্রস্তাব করেছি। এই তামাক চাষ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে হালদা নদীর মৎস্য প্রজনন হেরিটেজ বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা নদীতে ভয়াবহ রকমের বালু দস্যুতা বন্ধ করার জন্য ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ফটিকছড়ি, রাউজান এবং হাটাজারীর ১৭টি বালু মহাল ইজারা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার বালু মহালগুলো এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এখানে মূলত বালু মহাল নেই, বালু দস্যুরা হালদা নদীর মাটি বিক্রি করে দিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় নদীর আকৃতি বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। এতে পানির গুণগতমান পরিবর্তন, ভাটি এলাকায় ব্যাপকভাবে সিলটেশন হয়ে নদীর গভীরতা নষ্ট এবং পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া নদীর স্রোতের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন, মাছের খাদ্যের প্রাচুর্যতা নষ্ট এবং সার্বিকভাবে নদীর প্রজনন পরিবেশ এবং মাছের আবাসস্থল নষ্টও হচ্ছে।
পূর্বকোণ/ইব