চট্টগ্রাম বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

ঢাকা নির্ভরতায় ধুঁকছে চট্টগ্রামের চামড়াশিল্প
ফাইল ছবি

ঢাকা নির্ভরতায় ধুঁকছে চট্টগ্রামের চামড়াশিল্প

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৫ মে, ২০২৫ | ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

একে একে ট্যানারি শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসা হয়ে যায় ঢাকা নির্ভর। এরপর নানা সংকটে ধুঁকছে এখানকার চামড়াখাত। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ঢাকার ট্যানারি মালিক সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। তাদের মর্জিমাফিক দরে চামড়া বিক্রি করতে হয়। আর পাওনা টাকা পেতে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর।

 

ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের প্রায় ৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এছাড়া ২০১৫-২০১৮ সালের বকেয়া রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এভাবে প্রতিবছর ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে পুঁজি আটকে যাচ্ছে। এসব পাওনা আদায় করা যাচ্ছে না। ক্রমাগত লোকসান ও পুঁজি হারিয়ে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে।

 

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, টাকা সংকটে ধুঁকছেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। গত বছরের বকেয়া টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। এর আগেরও প্রায় ২৫ কোটি টাকা বকেয়া পাওনার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিবছর কোরবানি আসলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর বৈঠক করে। আমরা সংকটের কথা বলে আসছি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। চট্টগ্রামে আরও দু-একটি ট্যানারি থাকলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পেতেন বলে জানান তিনি।

 

আবদুল কাদের বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে কাঁচা ও লবণজাত চামড়া বেচাকেনা এবং চামড়া বিক্রির টাকা পাওয়ার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নজরদারি করলে ব্যবসায়ীরা সুফল পেতো।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাধীনতার আগে চট্টগ্রামে ৩০টি ট্যানারি ছিল। স্বাধীনের পরও ২২টি জিইয়ে ছিল। পুঁজি সংকট ও পরিবেশ দূষণের বিধি-বিধানের বেড়াজালে পড়ে ৮০-৯০ এর দশকের সংকটে পড়ে চামড়াশিল্প। বন্ধ হতে থাকে একের পর এক ট্যানারিশিল্প। বর্তমানে টিকে রয়েছে মাত্র একটি ট্যানারি।

 

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রাম চামড়াশিল্পের বড় বাজার ছিল। ট্যানারি বেশি ছিল। ব্যবসায় প্রতিযোগিতা ছিল। চামড়ার ভালো দর পাওয়া যেত। কিন্তু ৮৫-৯০ দশকের পর ধীরে ধীরে সবকটি ট্যানারি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সংকটে পড়ে চট্টগ্রামের ব্যবসা। শেষ এক দশক ধরে কঠিন সময় পার করছে ব্যবসায়ীরা।

 

চলতি বছর চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান প্রবীণ আড়তদার মুসলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই চামড়া সংরক্ষণের জন্য অর্থ জোগাড়, গুদাম সংস্কার, লবণ সংগ্রহ ও শ্রমিক সংগ্রহসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আড়তদাররা। উপজেলা পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহকারী প্রান্তিক ব্যবসায়ীরাও চামড়া কেনা-সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

 

করোনার ধাক্কা : ২০১৯ ও ২০২০ সালে চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনায় বড় ধস নেমেছিল। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করতে না পারায় হাজার হাজার চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। বিভিন্ন মাদ্রাসা, এতিমখানায় সংগ্রহ করা চামড়াও বিক্রি করতে না পারায় মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। সেই ধাক্কায় বড় ধরনের ধস নামে চামড়া ব্যবসায়।

 

কোরবানিদাতা ও চামড়ায় বড় ফারাক : জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব বলছে, চলতি বছর চট্টগ্রাম জেলায় কোরবানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ লাখ ৯৬ হাজার ২৬৯টি। এর বিপরীতে স্থানীয় জোগান রয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার ৮৮২টি।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত বছর চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল তিন লাখ ৬০ হাজার ৯৫০ পিস। অথচ প্রাণিসম্পদের হিসাবে কোরবানির পশুর চাহিদা ধরা হয়েছিল ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬৫টি। এর আগের বছর ২০২৩ সালে সংগ্রহ করা হয়েছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৮০০ পিস চামড়া। সেবার ৮ লাখ ১৭ হাজার ১২৯টি পশু কোরবানিতে জবেহ হয়েছিল বলে জানিয়েছিল প্রাণিসম্পদ বিভাগ।

 

প্রতি বছর কোরবানির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চামড়া সংগ্রহ হয় অর্ধেকের চেয়ে কম। অবশিষ্ট চামড়া কোথায় যায় সেই হিসাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তাদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আহ্বায়ক মো. আবদুল জলিল পূর্বকোণকে বলেন, সরকারি দপ্তর ও আমাদের সংগৃহীত চামড়ার হিসাবে কোরবানিদাতা ও চামড়া হিসাবে অর্ধেকের চেয়ে কম হয়। অবশিষ্ট চামড়া কোথায় যায় তা চিন্তার বিষয়।

 

তিনি বলেন, আগে চট্টগ্রামে ৫ লাখের কাছাকাছি চামড়া সংগ্রহ করা হতো। কয়েক বছর ধরে তিন লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ সংগ্রহ করা হয়।

 

ঢাকানির্ভরতার পর থেকেই সংকট : চট্টগ্রামে ২২টি কারখানা থেকে এখন আছে মাত্র একটি। টি কে গ্রæপের এ সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি কালুরঘাটে শিল্পাঞ্চলে ১৯৯১ সালে স্থাপন করা হয়। চট্টগ্রাম ও অন্য জেলা থেকে কোরবানিতে এক থেকে দেড় লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশড পর্যন্ত কমপ্লায়েন্স (পরিবেশ দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) মেনে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাংলাদেশে এলডব্লিউজির সনদ পাওয়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও জুতা রপ্তানি করে আসছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

 

রিফ লেদার চট্টগ্রাম থেকে লক্ষাধিক পিস চামড়া সংগ্রহ করে। এছাড়া চট্টগ্রামে সংগ্রহীত চামড়া বিক্রি করতে হয় ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। তারা চামড়ার বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্যবসায়ীরা কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় তাদের মর্জিমাফিক দরে চামড়া বিক্রয় করতে বাধ্য হন। লবণজাত চামড়ায় ২৫-৩০ শতাংশ বাদ দেওয়া হয়। সব অনিয়ম মেনে নিতে হয়।

 

১৯৮৬ সাল থেকে চট্টগ্রামে ট্যানারিশিল্পের ব্যবসা করে আসছেন হাজি আবু মোহাম্মদ। তিনি বলেন, আমেরিকা, স্পেন, ইতালি, জাপান, কোরিয়াসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে আমরা চামড়া রপ্তানি করতাম। পরিবেশ দূষণের নামে কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়েছে।

 

আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ২৫০-৩০০ আড়তদার-ব্যবসায়ী থেকে কমে এখন ২৫-৩০ জনে ঠেকেছে। পুঁজি হারিয়ে অন্যরা দেউলিয়া হয়ে গেছেন।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন