নিজ শহর, নিজের ঘরবাড়ি ঘুরে গেলেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথমবার নিজের শহর চট্টগ্রামে আসলেন তিনি। হাটহাজারীর এ সন্তান ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন। দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিহাস রচনা করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় করেন। কে জানতো বাথুরার হাজী মোহাম্মদ দুলা মিয়া সওদাগর বাড়ির ছেলেটি একদিন বিশ্বজয় করবেন। বিশ্বজয়ী সেই ইউনূস এবার নতুন করে জয় করলেন নিজ শহরের মানুষদের।
গতকাল সকাল সোয়া ৯টায় চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দিনভর নানা অনুষ্ঠানে কর্মব্যস্ত ছিলেন। রাত পৌনে ৮টার দিকে রাজধানী উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ছেড়ে যান। প্রায় ১০ ঘণ্টা সভা-সেমিনার ও প্রকল্প উদ্বোধন ব্যস্ত সময় কাটান।
চট্টগ্রামে পদার্পণ করেই প্রথমে ছুটে যান দেশের লাইফ লাইনখ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একগুচ্ছ প্রকল্প নিয়ে মতবিনিময় করেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন চট্টগ্রামবাসীর বহুল প্রত্যাশিত-কাক্সিক্ষত কালুরঘাট সেতুর। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসন, হার্ট ফাউন্ডেশনকে জমি দান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে পৃথক তিনটি হাসপাতাল পরিকল্পনার কথা বলেন। এরপর যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। শেষে নিজের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক ও বাথুয়ার পৈত্রিক বাড়িতে যান।
চট্টগ্রামের কোনো সন্তান এই প্রথম সরকারপ্রধান হিসেবে নিজ শহর চট্টগ্রামে আসলেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের শিক্ষকতা জীবনের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি-লেট প্রদান করে। নিজের শহরে একগুচ্ছ উন্নয়ন উপহার দিয়ে তিনি নিয়ে যান এ বিরল সম্মাননা।
কালুরঘাট সেতু : চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের বহুল প্রত্যাশিত কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টা। সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ফলক উন্মোচন করেন তিনি।
রেলসহ সড়ক সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কালুরঘাট সেতুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। কালুরঘাট সেতু তৈরি হয়ে গেলে চট্টগ্রামবাসীর বহু কষ্টের অবসান হবে।
হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল নির্মাণে জমিদান : স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ খাতে প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি চট্টগ্রামে। অথচ এ শহরকে দেশের দ্বিতীয় বা বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয়। হৃদরোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের জন্য জমি বরাদ্দের দলিল হস্তান্তর করেছেন তিনি। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুস সালামের হাতে জমির দলিল তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা। এরফলে চট্টগ্রামবাসীর আন্তর্জাতিকমানের বিশেষায়িত হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণ হতে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবায় তিন হাসপাতাল : ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার হাটহাজারী ও কর্ণফুলী এলাকায় দুটি হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। এছাড়াও কালুরঘাট এলাকায় একটি ডেন্টাল কলেজ ও ডেন্টাল হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা আছে বলেও জানান তিনি।
নগরের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা দূর করার নির্দেশ : প্রধান উপদেষ্টা ‘চট্টগ্রাম মহানগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘মতবিনিময়’ সভায় অংশ নেন। জলাবদ্ধতা চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে আগের তুলনায় অর্ধেকে এবং ক্রমান্বয়ে শূন্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। জলাবদ্ধতা নিরসনের নির্দেশনা ছাড়াও অক্সিজেন-হাটহাজারী মহাসড়কের উন্নয়নে মতবিনিময় সভায় অংশ নেন তিনি।
চট্টগ্রামবাসীকে ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্প উপহার দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্বজয়ী ড. ইউনূসকে কী উপহার দিল চট্টগ্রাম। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি-লিট) ডিগ্রি প্রদান করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৫ম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
প্রথম পাঠের স্মৃতি রোমন্থন : চবি সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষ করে পরিদর্শন করেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম শাখা। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ হাটহাজারীর জোবরা গ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা। গ্রামীণ ব্যাংকের সেই আঁতুড়ঘর পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বিকেল ৪টার দিকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম শাখা পরিদর্শন করেন।
গ্রামীণ কল্যাণের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মো. ওমর ফারুক জানান, স্যারের নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ জোবরা আর্কাইভ হচ্ছে সমৃদ্ধশালী একটি জাদুঘর। গ্রামীণ ব্যাংক ও স্যারের জীবনের অনেক দুর্লভ স্মৃতি সংরক্ষণ রয়েছে। পরিদর্শনে এসে মেয়েকে স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে নিজেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ১১ বছর পর তিনি এ কার্যালয়ে যান।
বাপের বাড়িতে হই-হুল্লোড় :
শেষে যান পৈত্রিকবাড়ি হাজী মোহাম্মদ দুলা মিয়া সওদাগর বাড়িতে। সেখানে পাড়া-পড়শী ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে এক সম্মিলনীতে অংশ নেন। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আপনজনদের সঙ্গে আড্ডা-কথামালায় মাতিয়ে তুলেন আপনজনদের। নিকট আত্মীয় ও এলাকাবাসীদের পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ছিলেন। কেতাবি ভাষার বদলে খাঁটি চাটগাঁইয়া ভাষায় মেতেছিলেন। পিতামহ হাজী মোহাম্মদ নজু মিঞা সওদাগর বাড়ির অদূরে কবরস্থানে শায়িত দাদা-দাদিসহ মুরুব্বিদের করব জেয়ারত করেন।
পূর্বকোণ/ইবনুর