চট্টগ্রাম রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

সর্বশেষ:

‘তকমায়’ দ্বিতীয় রাজধানী চিকিৎসায় যোজন দূরে
অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস

‘তকমায়’ দ্বিতীয় রাজধানী চিকিৎসায় যোজন দূরে

অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস

১৪ মে, ২০২৫ | ৪:০৯ অপরাহ্ণ

পাহাড় আর সাগরের মাঝে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম, যা দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত। সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলকেন্দ্র এই মহানগরী হলেও, চিকিৎসাখাতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ২০২২ সালের শুমারি অনুযায়ী, চট্টগ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ১০ মিলিয়ন, এবং আশপাশের এলাকা মিলিয়ে এর সংখ্যা প্রায় ১১ মিলিয়ন। এই বিশাল জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত থাকে। তবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা এবং আধুনিক চিকিৎসা সুযোগের অভাবে এখানকার জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। পাশাপাশি রয়েছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, বিআইটিআইডি, বক্ষব্যাধি, বন্দর, মেনন হাসপাতাল ও আর্মি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তবে এসব হাসপাতালে সাধারণ জনগণের জন্য চিকিৎসা সেবা সীমিত। বিশেষত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যেখানে রোগীদের ভিড় এতটাই বেশি যে, মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই হাসপাতাল ছাড়া অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে সেবা পেতে জনসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা সীমিত, যার ফলে সাধারণ জনগণের চিকিৎসা পাওয়ার একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

 

এছাড়া, দিনে দিনে চট্টগ্রামে উচ্চ ব্যয়ের বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও অন্যান্য হাসপাতাল গড়ে উঠছে, তবে সেগুলোও সবসময় সাধারণ জনগণের জন্য সুলভ নয়। সিটি করপোরেশনের পঞ্চাশের অধিক চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র পরিচালনা করলেও, তা যথেষ্ট নয়। একদিকে যেমন সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ সীমিত, অন্যদিকে আধুনিক রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সংযোজনের অভাব রয়েছে। বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতালের অভাবও ব্যাপক।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিড় সামাল দিতে বিভিন্ন নতুন উদ্যোগ প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে বাণিজ্যিকীকরণ নয়, বরং স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন ও মান বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া। বর্তমান সময়ের বাস্তবতায়, কোনো একটি বড় হাসপাতালের বদলে চট্টগ্রামের চারদিকে ২৫০ শয্যার ৪টি হাসপাতাল স্থাপন করা যেতে পারে, যা শহরের চারটি নির্গমন সড়কে কিছু দূরত্বে স্থাপিত হবে। এতে চিকিৎসার সেবা আরও বিকেন্দ্রীকৃত ও সহজলভ্য হবে, এবং হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হবে।

 

এছাড়া, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে ক্যানসার হাসপাতাল স্থাপন নিয়ে যে পরিকল্পনা হচ্ছে, তা জনমতের বিরুদ্ধে এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ না নিয়ে করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি করবে।

 

চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতকে আরও উন্নত করার জন্য কিছু বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন। দেশে ও বিদেশে নিয়মিত পেশাগত অনুশীলন, দক্ষ জনবল বৃদ্ধি, এবং গুড মেডিকেল প্র্যাকটিস গাইডলাইন প্রণয়ন করা জরুরি। এছাড়া, সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চিকিৎসা সেবা সংক্রান্ত অন্তর্জাল সংযোগ করতে হবে, যাতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবা আরও সহজলভ্য হয়।

 

বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে হৃদরোগ, কিডনি রোগ, শ্বাসরোগ, আঘাতজনিত রোগ, নিউরোলজি, গেস্টোহেপাটোলজি এবং ইমেজিং সংক্রান্ত হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, এবং চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কৌশলগত জোট গড়ে তুললে, তা চিকিৎসা খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

অতএব, চট্টগ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও জনগণের জন্য উপযোগী করার জন্য সরকার, সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘সুযোগ, সামর্থ এবং আচরণের সমন্বয়ের মাধ্যমে, কোনো জীবন প্রদীপ যেন নিভে না যায়’।

 

এ কাজের নেতৃত্ব দিতে হবে চট্টগ্রামের মেয়রকে, যিনি জনগণের কল্যাণে, পাল্টানো মাইন্ডসেটের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে স্বাস্থ্যবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। চট্টগ্রামবাসীর এই আশা পূরণ করা সরকারের কাছে অন্যতম প্রধান প্রত্যাশা।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট