চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

সর্বশেষ:

‘চাটগাঁইয়া’ ব্যবসায়ীদের ওপর ওজন স্কেলের খড়গ
অতিরিক্ত ওজন থেকে মহাসড়ক রক্ষার অজুহাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগার হাট অংশে ‘এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ স্থাপন করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ

‘চাটগাঁইয়া’ ব্যবসায়ীদের ওপর ওজন স্কেলের খড়গ

আরাফাত বিন হাসান

১৪ মে, ২০২৫ | ১:৫৩ অপরাহ্ণ

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। গেলো প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্থাপিত ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বাণিজ্যিক রাজধানীর ব্যবসায়ীরা। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে মালবাহী ট্রাকে ১৮ থেকে ২২ টন পণ্য পরিবহন করার সুযোগ থাকলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করলে জরিমানা গুনতে হয় চালককে।

 

তাই একসঙ্গে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছেন না ‘চাটগাঁইয়া’ ব্যবসায়ীরা। এতে পরিবহন ব্যয় বাড়ছে তাদের। আর পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির এ খড়গ সরাসরি পড়ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে। ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে ভারতীয় বণিকদের সুবিধা দিতে এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের প্রভাব কমাতেই আওয়ামী লীগ সরকার মহাসড়ক রক্ষার নামে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে এ বৈষম্য করেছিল।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পণ্যবাহী যানের অতিরিক্ত ওজন থেকে মহাসড়ক রক্ষার অজুহাতে ২০১৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুটি অংশে ‘এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ নামে দুটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এর একটি সীতাকুণ্ডের বড় দারোগার হাটে এবং অন্যটি স্থাপন করা হয় কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায়।

 

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের পর থেকেই হয়রানি, বৈষম্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। দেশের অন্য কোথাও পণ্যবাহী যানের ওজন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করে কেবল চট্টগ্রামে এমন ব্যবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জানিয়ে দীর্ঘদিন নানা মহলে ধরনা দেন তারা। সংশ্লিষ্ট সব মহলসহ বিগত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান তারা। তবে তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

 

দেশে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের দাবি, ওজন স্কেল ঘিরে চাঁদাবাজি চলে হরহামেশা। এর মধ্যে আবার ওজন স্কেলের কারণে খাতুনগঞ্জমুখী ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের অনেক ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে ঢাকামুখী হয়েছেন। এতে ব্যবসায়িকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারা।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, দেশের অন্যান্য জেলায় ২২-৩০ টন পণ্য পরিবহন করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আমরা এই ওজন স্কেলের কারণে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছি না। এতে খরচ যেমন বেড়েছে, পণ্যের বেচাবিক্রিও কমে গেছে। সবমিলিয়ে আমরা চাটগাঁইয়ারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তাই অবিলম্বে এটার অপসারণ প্রয়োজন।

 

অনেকটা একই কথা বলেন এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান মিন্টু। তিনি বলেন, ওজন স্কেল শুধু চট্টগ্রামে স্থাপন করা হয়েছে। গেলো আট বছর এটার কারণে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। দেশের সব মহাসড়কে একসঙ্গে ওজন স্কেল চালু হলে আমাদের আপত্তি ছিল না।

 

ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ দাবি করেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতকে সুবিধা দিতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্থাপন করা হয় এ ওজন স্কেল।

 

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার-সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের ধারণা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে খুশি করার জন্য যা যা করা দরকার সবই করেছে। দেশের চারদিকে তাদের ট্রানজিট দেওয়া হয়েছে। আমরা যারা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী আছি, আমাদের দুর্বল করে ভারতীয়দের জন্য অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করতেই এখানে ওজন স্কেল বসানো হয়েছে। নয়তো দেশের কোথাও স্কেল স্থাপন না করে চট্টগ্রাম বন্দরের মুখে কেন স্কেল স্থাপন করলো?

 

ওজন স্কেলের কারণে দেশের কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক পুরনো পাইকারি ক্রেতা খাতুনগঞ্জ বিমুখ হয়ে গেছেন দাবি করে মো. মহিউদ্দিন বলেন, ওজন স্কেল স্থাপনের আগে ওদিকের শত শত ব্যবসায়ী আমাদের ক্রেতা ছিলেন। এখন তারা খাতুনগঞ্জ থেকে পণ্য নেন না, এতে খরচ বেশি হয়।

 

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের প্রচার, প্রকাশনা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ফরিদুল আলম বলেন, এ স্কেলের কারণে তুলনামূলক খরচ বাড়ছে; অনেকেই চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের পরিবহন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমরা এ বৈষম্যের নিরসন চাই। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চাই।

 

সীতাকুণ্ডে স্থাপিত এই ওজন স্কেল চট্টগ্রামের সঙ্গে ‘বৈষম্য’ বলে দাবি করছেন পরিবহন নেতারাও। চট্টগ্রাম প্রাইমমুভার ও ফ্লাটবেড ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, অতিরিক্ত ওজন নিলে আমাদের জরিমানা হোক, এতে দুঃখ নেই। কিন্তু সারাদেশকে বাদ দিয়ে কেবল চট্টগ্রামেই কেন এটা বসানো হলো? আমাদের ধারণা এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে। এর কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

 

তিনি আরও বলেন, তাছাড়া মালবাহী গাড়ির ক্ষেত্রে সাত এক্সেল পর্যন্ত নীতিমালা আছে, কিন্তু সাত এক্সেলের চেয়ে বেশি এক্সেলের গাড়ির ক্ষেত্রে পরিমাপ কেমন হবে সেটা ওরা নির্ধারণ করে দেয়নি। এখন রোডস এন্ড হাইওয়ের কর্মকর্তারা পণ্যবাহী গাড়ি আটক করে জরিমানার নামে টাকা আদায় করে। কোন রিসিটও দেয় না।

 

তবে নতুন করে দেশের ১৯ জেলার ২১টি স্থানে মহাসড়কে আরও ২৮টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। চট্টগ্রাম জেলা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকোশলী মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন বলেন, সারাদেশে আরও বেশকিছু ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। সড়কের নিরাপত্তার জন্যই এটা স্থাপন করা হয়েছে; সারাদেশেই স্থাপন করা হবে। বৈষম্যের বিষয়টি সঠিক নয়।

 

দেশের অন্য কোথাও চালু না থাকলেও গেলো আট বছর ধরে কেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার পূর্বের কর্মকর্তারা জানেন। তখন নিশ্চয় ওরকম কোন প্রেক্ষাপট ছিল। এ বিষয়ে পূর্বের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে হবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট