শিশুদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ২০১৭ সালে বন্দরনগরীতে ২০০ শয্যার বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় সরকার। এরপর হাসপাতাল বাস্তবায়নে শুরু হয় জমি দেখা। ভূমি অধিগ্রহণে বরাদ্দ হয় অর্থও। প্রায় এক বছর পর জমির খোঁজ পেলেও নানা জটিলতায় তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রতা।
প্রকল্প গ্রহণের সাত বছর পর একপর্যায়ে কিছুটা কূল-কিনারায় আসে প্রকল্প বাস্তবায়ন। চূড়ান্ত হয় নকশা। যাবতীয় কাজও এগোয় অনেকখানি। কিন্তু এরইমধ্যে গেলো বছরের শুরুতেই ফের হোঁচট খেতে হয় কার্যক্রমে। একই জায়গায় সরকারের অন্য প্রকল্পের প্রস্তবনায় ঝুলে যায় বিশেষায়িত এ হাসপাতাল নির্মাণের কাজ। যার কারণে এখনও ঝুলে আছে শিশু হাসপাতালের ভাগ্য।
তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম শহরে ২০০ শয্যার একটি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল স্থাপনের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগ। ফিজিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট (পিএফডি) শীর্ষক অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। যদিও পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। অর্থ বরাদ্দের অন্যতম শর্ত ছিল হাসপাতালটি শহরের মধ্যে ও প্রধান সড়কের পাশে তিন একর জায়গায় নির্মাণ করতে হবে। এজন্য গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে কাজ শুরুর কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু শহরের ভেতর স্থান নির্ধারণ করতে না পারাসহ জমি নিয়ে নানান জটিলতায় এখনও নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, বিভাগীয় শহরে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়ায় হতাশ এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসকরা। শিশুদের চিকিৎসায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ এবং বেসরকারি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের উপর নির্ভর করতে হয় পুরো বিভাগের মানুষকে। এ কারণে সারাবছরই শিশু রোগীদের কয়েকগুণ চাপ থাকে এ দুই হাসপাতালে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। তাই শিশুদের উন্নত চিকিৎসাসেবায় স্বতন্ত্র বিশেষায়িত এ হাসপাতাল নির্মাণ খুবই জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভূমি জটিলতা কাটেনি ৮ বছরেও: ২০১৭ সালে প্রকল্প গ্রহণ করলেও জমির খোঁজে কেটে যায় এক বছর। জমি চিহ্নিত করে ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্মাণ অধিশাখা থেকে বাকলিয়া মৌজার মোট দুই একর জমির প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান করা হয়। কিন্তু ওই জমিতে স্থাপনা নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করতে গেলেই সৃষ্টি হয় জটিলতা।
জানা যায়, পছন্দকৃত জমির একটি অংশে সিডিএ’র মহাপরিকল্পনার আওতায় কর্ণফুলী রিভারফ্রন্ট রোড এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন শাহ আমানত ব্রিজ কানেক্টিং রোডের প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। যার কারণে অধিগ্রহণকৃত এলাইনমেন্ট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট জমিতে (১ দশমিক ৪৬ একর) স্থাপনা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে অনাপত্তিপত্র প্রদান করে সিডিএ। কিন্তু তাতে প্রয়োজনীয় ভ‚মির চেয়ে প্রায় এক চতুর্থাংশ কমে যাওয়ায় হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণে জটিলতা দেখা দেয়। যদিও এ জটিলতা নিরসণের জন্য একাধিকবার চিঠি চালাচালিসহ নানান উদ্যোগ গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে, প্রয়োজনীয় ভূমির চেয়ে প্রায় এক চতুর্থাংশ কম জমিতেই অন্য স্থাপনা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রধান হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব দেন তৎকালীন সিভিল সার্জন। এরপর ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর জমি অধিগ্রহণে অনাপত্তিও দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। যার প্রেক্ষিতে গণপূর্ত বিভাগ জমির পরিমাপ শেষে নকশা প্রণয়নের জন্য স্থাপত্য অধিদপ্তরে চিঠি দেয়। স্থাপত্য অধিদপ্তর তা চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করে। শুধু চিঠি চালাচালিতেই শেষ হয় প্রকল্পের মেয়াদ। যদিও পরবর্তীতে মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু এর মধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একই জায়গায় ‘স্পোর্টস এরেনা’ নামে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। যা নিয়ে বাধে বিপত্তি। অবশ্য ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি এ বিষয়ে তৎকালীন জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী শিশু হাসপাতাল নির্মাণের জন্য নির্ধারিত হওয়া জায়গায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করতে চিঠি প্রেরণ করেন।
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, প্রকল্পটির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। যেহেতু আমি নতুন এসেছি; এ বিষয়ে আমার জানা নেই। পরবর্তীতে কী করণীয়, তা জেনে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের দাবি: রাজধানী ঢাকায় বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালসহ একাধিক বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকলেও দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরীতে এখন পর্যন্ত গড়েই উঠেনি কোন বিশেষায়িত হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র। যার কারণে এ অঞ্চলের মানুষকে চিকিৎসাসেবার জন্য নির্ভরশীল থাকতে হয় একমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ওপর। তাতে করে হাসপাতালটিতেও ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চাপ পড়ে। এতে রোগীরাও তাদের কাক্সিক্ষত সেবা নিতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েন। তবে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল চালু হলে সেবাদান আরও সহজ হয়ে উঠবে। তাই দ্রুতসময়ের মধ্যে শিশু হাসপাতালের ভূমি জটিলতা নিরসণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের দাবি চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকদের।
পূর্বকোণ/ইবনুর