চট্টগ্রাম শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

সর্বশেষ:

আঁরার হ-তা য়ুনিবার কেউ নাই
কালের সাক্ষী স্রোতঃস্বিনী কর্ণফুলী কালের বিবর্তনে এখন অবৈধ দখলে চিড়ে চ্যাপ্টা ও ক্ষীণপ্রায়

আঁরার হ-তা য়ুনিবার কেউ নাই

পূর্বকোণ রিপোর্ট

১৪ মে, ২০২৫ | ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ

‘আঁরা চাটগাঁইয়া অল ভালা নাই। আঁরারে চাইবার কেউ নাই। আঁরার আশা, এইবার আঁরার ইউনুস আঁরার হ-তা য়ুনিবো’। (আমরা চট্টগ্রামের লোকেরা ভাল নেই। আমাদের দেখার কেউ নেই। আমাদের আশা, এবার আমাদের ইউনুস আমাদের কথা শুনবেন)।

 

পাকিস্তান আমল বাদ দিলে স্বাধীনতাত্তোর ৫৪ বছর ধরে অবহেলিতই রয়ে গেছে চট্টগ্রাম। সাগর, নদী, পাহাড়- এই তিনের মেলবন্ধনে যে অপরূপ নগরী সেই নগরীর কাক্সিক্ষত ও পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি এতগুলো বছরেও। অবকাঠামোগত সুবিধা ও ঐতিহ্যগত অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে চট্টগ্রামকে সেভাবে কেউই মূল্যায়ন করেনি। যে কারণে পাঁচ দশক পরও চট্টগ্রাম থেকে গেছে অবহেলিত। অথচ চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির প্রাণ কেন্দ্র।

 

বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বন্দর হিসাবে বিবেচিত কর্ণফুলীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে আয় হয় দেশের সিংহভাগ রাজস্ব। সেই কর্ণফুলী দখল ও দূষণে এখন বিপর্যস্ত। কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে লোপাট হয়েছে বিপুল অংকের আর্থ। তদারকি না থাকায় নদীর দুই পাড় দখল গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। এছাড়া কর্ণফুলীর সাথে সংযুক্ত খাল সমূহ দিয়ে প্রতিনিয়ত গড়িয়ে পড়ছে দূষিত বর্জ্য। দূষণের কারণে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত। কর্ণফুলী রক্ষায় এই মূহুর্তে প্রয়োজন পরিকল্পিত ও কার্যকর উদ্যোগ।

 

অনেক উদ্যোগের শুরু চট্টগ্রামে:

দেশের ঐতিহাসিক অনেক উদ্যোগই চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের দেশ গার্মেন্টস থেকে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যদিও আনুষাঙ্গিক অসুবিধার কারণে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় চলে যায়। এখনও ইস্পাত শিল্পের প্রধানতম কারখানাগুলো এখনও চট্টগ্রামে। ঢেউটিন তৈরির কারখানা কোল্ড রোল মিলস, বিলেটসহ ইস্পাত কারখানা চিটাগাং স্টিল মিলস, জাহাজভাঙা ও নির্মাণ কারখানার গোড়াপত্তন হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। মোটরগাড়ি, ফ্রিজ, পেপার মিল, রঙের কারখানাসহ বহু নতুন উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। চা বাগানের সিংহভাগ সিলেটে হলেও বাণিজ্যনগর হিসেবে নিলাম কেন্দ্র চালু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে।

 

ভারত উপমহাদেশে কমরেড ব্যাংক, ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে। এ এন জেড গ্রিন্ডলেজ চট্টগ্রামের সদরঘাটে প্রথম শাখা চালু করেছিল। এই ব্যাংক ২০০০ সালে অধিগ্রহণ করে বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ন্ড চাটার্ড ব্যাংক। তারাও ১৯৪৮ সালে এ অঞ্চলে চট্টগ্রামে শাখা কার্যালয় দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল।

 

পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামে ইউনিলিভার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বার্জার, ডানকান ব্রাদার্সসহ অনেক বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কোম্পানিগুলো তাদের অফিস গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে ঢাকায়। সরকারি ছাড়াও অনেক বেসরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয়ও ঢাকায়। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চট্টগ্রামের জনগণকে। দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার কথা শুনে আসলেও বাস্তবায়নের মুখ আজও দেখা যায়নি। ছোটখাটো কাজে এখনও ছুটে যেতে হয় ঢাকায়। সকল কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম তার ঐতিহ্যগত গুরুত্ব হারিয়েছে। অনেকেই মনে করেন, প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক দিক থেকে চট্টগ্রাম তার গুরুত্ব অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে।

 

নগরীর জলাবদ্ধতা: চট্টগ্রাম নগরবাসীর প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। প্রতি বছর বর্ষায় নগরীর সিংহভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ঘটে প্রাণহানি। ঘটে সম্পদহানি। হাজার হাজার বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে যাওয়ায় শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যায়। এ্ই জলাবদ্ধতা নিরসনে এরইমধ্যে ৪টি প্রকল্পে ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও মুক্তি মিলেনি জলাবদ্ধতার কবল থেকে।

 

ওজন স্কেল: আরেকটি বৈষম্যমূলক বিষয় হচ্ছে ওজন স্কেল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কর সীতাকুন্ডে স্থাপিত এই ওজন স্কেল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের অসম প্রতিযোগিতা ফেলে দেয়া হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম ব্যতীত দেশের অন্য কোথাও পণ্য পরিবহণের ওজন স্কেল নেই। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীর দীর্ঘদিন এই ওজন স্কেল তুলে নেয়ার দাবি জানিয়ে আসলেও কেউ শুনেনি ব্যবসায়ীদের এই দাবি।

 

চিকিৎসাসেবা: চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও, চিকিৎসা সেবায় অনেক পিছিয়ে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখানে গড়ে ওঠেনি কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল, এবং সরকারি হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি সেভাবে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যা বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, তাতে রোগীদের ভিড় এতটাই বেশি যে, মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যদিও সরকারি-বেসরকারি মিলে কিছু ছোটখাটো স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, তবুও সেগুলো সাধারণ মানুষের জন্য সুলভ নয়। বিশেষায়িত চিকিৎসা, যেমন হৃদরোগ, কিডনি, নিউরোলজি, পেডিয়াট্রিকস, বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি, ইত্যাদির জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালের অভাব রয়েছে, যার কারণে অনেক রোগীকে ঢাকায় কিংবা বিদেশে যেতে বাধ্য হতে হয়। স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং যথাযথ বিনিয়োগ না হওয়ায় চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবা এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের জনসংখ্যার তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা অনেক সীমিত, যা এখানকার মানুষকে বিপদে ফেলছে। তাই এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

 

হাইকার্ট বেঞ্চ: চট্টগ্রামে একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন এখন সময়ের দাবি। এই দাবি চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের। ঢাকায় হাইকোর্টে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে চট্টগ্রামবাসীকে অর্থহানীর পাশাপাশি পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। এই ভোগান্তি নিরসনে চট্টগ্রামে একটি হাইকোর্ট স্থাপন অতীব জরুরী।

 

সম্প্রসারিত হয়নি ইস্টার্ন রিফাইনারি: দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে ১৯৬৮ সালে। এরপর ৫৭ বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন তেল শোধনাগার নির্মাণ করা হয়নি। ক্রমবর্ধমান বিপুল চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যের পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির দিকেই হেঁটেছে বাংলাদেশ। ইআরএল ইউনিট-২ নামে নতুন একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। অর্থায়নসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

 

চাহিদা অনুযায়ী শোধনাগার না থাকায় পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে প্রতিলিটারে অন্তত ১০ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমলেও এর সুযোগ নেয়া যাচ্ছে না। এতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে। উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে দরকারি প্রকল্প তেল শোধনাগার করা হয়নি। আমদানির নামে জ্বালানি খাতকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করবো নতুন সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট