দেশের উপকূলীয় ১৬ জেলার ৭৫ উপজেলার সামুদ্রিক মৎস্য খাতে উন্নয়নে ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প’ নামে সরকার বড় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামে ৪টি অবতরণ কেন্দ্র (ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার) ও ৩টি মেরিন সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট নির্মাণের অনুমোদন ছিল। প্রকল্পটি এখন শেষ পর্যায়ে থাকলেও চট্টগ্রামে নির্মাণ হচ্ছে একটি মাত্র ফিশ সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট।
অপরদিকে প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামে ৪টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত থাকলেও একটিও নির্মাণ হচ্ছে না। বাঁশখালীতে একটি অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের টেন্ডার হলেও ভূমি সংক্রান্ত জটিলতায় শেষমেষ এটিও বাতিল হয়ে যায়।
মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বছরে বাংলাদেশে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হয় প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে সাগরে আহরিত বেশিরভাগ মাছ বিপণনের জন্য ফিশিং বোট ও ট্রলার থেকে খালাস করা হয় চট্টগ্রামে। অথচ চট্টগ্রামে সরকারিভাবে কোনো ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার নেই।
নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় বেসরকারিভাবে একটি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার রয়েছে। তাও আবার সেটি আধুনিকমানের নয়। এ অবস্থায় প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামে একটিও মাছ অবতরণ কেন্দ্র (ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার) নির্মাণ না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন মৎস্য আহরণের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরূপণ, আহরণ, বিপণন, নিয়ন্ত্রণ, নজরদারিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, গবেষণা, জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্য আহরণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকার সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পটি গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা। পরে অবশ্য সেখান থেকে ৬০০ কোটি টাকা কাটছাঁট হয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সারাদেশে প্রতিবছর মৎস্য উৎপাদন হয় প্রায় ৪৭ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ১৫ শতাংশ সামুদ্রিক মৎস্য ধরা হলে তাতে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হয় প্রায় ৭ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন। এসব সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হয় প্রায় ৬০ হাজার ফিশিং বোট ও ২৫০টি ট্রলারের মাধ্যমে। কিন্তু আহরণ ও নিয়ন্ত্রণের কোন তথ্য না থাকায় নানা সমস্যা ছাড়াও সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণের রাজস্ব হারায়। তাই এ খাতে উন্নয়নের জন্য সরকার দেশের ১৬টি উপকূলীয় জেলার ৭৫ উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের অধীনে শুরুতে সারাদেশের ১৬ জেলার উপকূলীয় এলাকায় ১৬টি ফিশ সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে চট্টগ্রামের স›দ্বীপ, বাঁশখালী, নগরীর পতেঙ্গায় ১টি করে ৩টি ফিশ সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট নির্মাণের অনুমোদন ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এ প্রকল্প সংশোধন করে নির্মাণ করা হয় মাত্র একটি ফিশ সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট। নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় এটি নির্মাণ করা হয়।
একই প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ১৮টি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার ও ফিশ হারবার নির্মাণের অনুমোদন ছিল। এরমধ্যে চট্টগ্রামের জন্য অনুমোদন ছিল ৪টি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টারের। এগুলো নগরীর পতেঙ্গায়, সীতাকুণ্ডের কুমিরায়, বাঁশখালী উপজেলায় ও দক্ষিণ কাট্টলীতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ভূমি সংক্রান্ত জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে চট্টগ্রামে একটিও ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার নির্মাণ হচ্ছে না।
তবে প্রকল্পের অধীনে মিরসরাইয়ে একটি ফিশ ডায়াগনোস্টিক ল্যাব ও নগরীর পতেঙ্গায় একটি ফিশ কোয়ারেন্টাইম ল্যাব তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও কর্ণফুলী নদীর ওপারে ইছানগরে বিএফডিসি এলাকায় একটি ৬ তলার মৎস্য ভবন, একটি আধুনিক অকশন সেট ও বরফকল নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণ শেষ হলে সেখানে আহরিত সামুদ্রিক মৎস্য অকশন দেওয়ার সুযোগ হবে।
সূত্র জানায়, মূলত মেরিন সার্ভিল্যান্স চেক পোস্টের কাজ হচ্ছে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক ফিশিং বোট ও ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ করা। বিশেষ করে সাগরে ফিশিং করতে যাওয়ার প্রাক্কালে ফিশিং বোট ও জাহাজের রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, অনুমোদিত জাল ব্যবহার, জেলেরা জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ব্যবহার করছে কিনা যাবতীয় মনিটরিং করা। পাশাপাশি চেক পোস্টে প্রতিটি ফিশিং বোট ও ট্রলারকে একটি করে ডিভাইস দেওয়া হবে। এটির মাধ্যমে বোট ও ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ, জরুরি সতর্কতা ও সুনামি সতর্কতা সংকেত পাঠানো এবং সাগরে জলদস্যুর হামলা কিংবা অন্য কোন বিপদে সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব হবে। ফিশিং বোট ও ট্রলারগুলো সাগরে মৎস্য আহরণশেষে ফেরার পথে পুনরায় চেকপোস্টে আহরণকৃত মাছের মনিটরিং করা হবে।
অপরদিকে ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টারের কাছ হচ্ছে, ফিশিং বোট ও ট্রলার থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে আহরণকৃত মাছ লোড-আনলোড করা। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও প্রতিটি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টারে বরফ কলের ব্যবস্থা থাকে। বিদ্যমান এসব সুযোগ সুবিধা মাথায় রেখে প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও স›দ্বীপে এবং চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গা ও কাট্টলী এলাকায় একাধিক মেরিন ফিশারিজ সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট, ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার, মেরিন ফিশারিজ সার্ভিল্যান্স পল্টুন, ফিশ হারবারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু বেশিভাগ ক্ষেত্রে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এসব স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে না।
জানতে চাইলে উপ-প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন, গবেষণা, মনিটরিংসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিশাল এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এটি বাস্তবায়ন করছে মৎস্য অধিদপ্তর। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের উপকূলীয় ১৬টি জেলার ৭৫ উপজেলার ৭৫০টি ইউনিয়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটির কাজ চলতি বছরের নভেম্বরে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মিজানুর রহমান বলেন, বাঁশখালীতে একটি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার নির্মাণের টেন্ডার হলেও ভূমি সংক্রান্ত জটিলতায় মামলার কারণে শেষমেষ এটিও বাতিল হয়ে যায়।
পূর্বকোণ/ইবনুর