বোরো চারা রোপণে ব্যস্ত মো. শফিক ও টুনু কুমার পাল নামে দুই শ্রমিক। রাস্তার ধারে বসে রোপণ-কাজ তদারকি করছেন জমির মালিক মো. মুনছুর। চাষাবাদ নিয়ে কথা বলতেই আক্ষেপ করে বলেন, শখ করেই চাষ করি। চাষাবাদে এখন লাভ নেই। অনেক সময় লোকসান গুনতে হয়।
মুনছুরের সঙ্গে কথা হয় বোয়ালখালীর খরণদ্বীপের ধোপার বিল এলাকায়। তিনি বললেন, বোরো চাষে সেচ, চাষ ও সার খরচ বেশি। বর্গাচাষিদের আবার খাজনা বা বর্গা খরচ গুনতে হয়। এজন্য বোরো চাষে কৃষকের আগ্রহ কম। আমনে কিন্তু বাড়তি খরচ না থাকায় আমনের প্রতি কৃষকের ঝোঁক বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে কৃষিকাজে যুক্ত করলডেঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার কুমকুম দাশ। তিনি বললেন, বোরো আবাদ হচ্ছে সম্পূর্ণ সেচনির্ভর। সার-কীটনাশকের ব্যবহারও বেশি করতে হয়। সেচ, চাষ ও সারের বাড়তি খরচে কৃষক দুশ্চিন্তায় থাকে। এছাড়া খরা, রোগ-বালাই ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে কৃষক পথে বসার উপক্রম হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমি। গতবছর (২০২৪ সাল) ছিল ৬৪ হাজার হেক্টর। ২০২৩ সালে ছিল ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। কয়েক বছর ধরে বোরো আবাদ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এজন্য বড় ধরনের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। সার ও সেচের বাড়তি খরচের কারণে বাড়ানো যাচ্ছে না বোরো আবাদ। গত মৌসুমে আমনের আবাদ হয়েছিল এক লাখ ৭৯ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমিতে। কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, বেশকিছু জমিতে বোরো আবাদের সম্ভাবনা থাকলেও সেচ সংকটের কারণে চাষাবাদ হয় না। তবে কিছু জমিতে রবি-খরিপ শস্যের চাষাবাদ হয়।
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান পূর্বকোণকে বলেন, বোরো চাষ হচ্ছে পুরোটায় সেচনির্ভর। এখানে সেচ সুবিধার স্বল্পতা রয়েছে। এছাড়াও আনোয়ারা ও বাঁশখালীতে কিছু এলাকায় সাগরের পানি ঢোকে। লবণাক্ততার কারণে চাষে ক্ষতি হয়।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বোরো মৌসুমে পুরোটাই সেচনির্ভর হয়। জমি তৈরি থেকে ধানের শীষ শক্ত হওয়া পর্যন্ত সেচ দিতে হয়। সেচ দেওয়া ছাড়া বোরো উৎপাদন সম্ভব নয়। সেচ সংকটের কারণে চাষ উপযোগী অনেক জায়গায় পানির সংকটে চাষাবাদ হয় না।
কৃষক কুমকুম দাশ বলেন, বোরো মৌসুমে খরা ও রোগ-বালাইয়ের আশঙ্কা বেশি থাকে। তাছাড়া কয়েক বছর ধরে অনাবৃষ্টির কারণে নদী-খালের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়েছিল। এতে চাষিরা বড় ধরনের মার খেয়েছিল। গভীর নলকূপের মিঠাপানিতে চাষ করলে খরচ আরও বাড়তি গুনতে হয়।
কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে বোরো চাষে গভীর নলকূপ ব্যবহৃত হচ্ছে ২৩টি। অগভীর নলকূপ ৩ হাজার ৪৪৮টি। এলএলপি ৪ হাজার ৭৫৯টি। অন্যান্য নলকূপ রয়েছে ৩ হাজার ১৩০টি। গভীর নলকূপের মধ্যে ২২টি বিদ্যুৎ ও একটি ডিজেলচালিত। অগভীর নলকূপের মধ্যে ২৪৫১টি বিদ্যুৎ ও ৯৯৭টি ডিজেলচালিত। এলএলপির মধ্যে ৮৪৭টি বিদ্যুৎ ও ৩৯১২টি ডিজেলচালিত। ২০১৪-২০১৫ সালে গভীর নলকূপ ছিল ৩০টি। অগভীর নলকূপ ২ হাজার ৬৬৯টি ও এলএলপি ৫ হাজার ৯৯৫টি।
গতমাসে বোরো মৌসুমের শুরুতেই ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১ টাকা বেড়েছে। ডিজেল খরচ বেড়ে যাওয়ায় আরেক দফায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষক। এছাড়াও কৃষকদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে সার। প্রতিকেজি ইউরিয়া ও টিএসপির কৃষক পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত মূল্য ২৭ টাকা। ডিলার মূল্য ২৫ টাকা। কৃষক পর্যায়ে ডিএপির মূল্য ২১ টাকা ও এমওপির মূল্য ২০ টাকা।
বোয়ালখালীর খরণদ্বীপের কৃষক মো. মুনছুর বলেন, সাদা সার ৩০ টাকা, মোটা ২৮ টাকা ও টিএসপি ৩৫ টাকা দরে কিনতে হয়েছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেচ ও সার খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের চাষাবাদ খরচও বেড়ে গেছে। কুমকুম মেম্বার ও মুনছুর বলেন, প্রতি কানি জমিতে সেচ খরচ নিচ্ছে প্রায় ২০০০ টাকা, ট্রাক্টর (তিন চাষ) খরচ ২০০০-২৫০০ টাকা, সার খরচ ২৫০০-৩০০০ টাকা, রোপণে শ্রমিক খরচ ৪ হাজার টাকা, ধান কাটার খরচ ৪ হাজার টাকা। এছাড়াও নিড়ানি ও পোকা-মাকড়ের উপদ্রব দেখা দিলে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। বর্গাচাষিদের কানিপ্রতি ৩০০০ টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়।
পূর্বকোণ/ইব