গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে গ্রামে দাপিয়ে বেড়ানো আবদুল্লাহ আল নোমান একসময় হয়ে ওঠেন বড় রাজনীতিবিদ। রাউজানের গহিরা গ্রামের দাপুটে ছেলেটি ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম শহর, এরপর সারাদেশে পরিচিতি পান একজন গ্রহণযোগ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য ও বিএনপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন।
২০১৩ সালের মার্চে দৈনিক পূর্বকোণকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, দীর্ঘ রাজনীতির জীবনে মন্ত্রিত্ব, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সামরিক আদালতে তার সাজা হয়েছিল। কিন্তু তিনি খবরটি জানতেন না। ওই সময় দৈনিক আজাদী অফিসে গিয়ে পত্রিকাটির তৎকালীন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের কাছে তিনি খবরটি জানতে পারেন। অধ্যাপক খালেদ তাকে দ্রুত নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে পরামর্শ দেন। পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে তিনি নগরীর প্যারেড ময়দানের পাশে এক ভগ্নিপতির বাসায় যান; তবে দরজায় তালা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।
এ সময় তার পকেটে আর কোন টাকা ছিল না। নিরুপায় হয়ে তিনি একই এলাকায় তার অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় যান। ওই আত্মীয় ছিলেন উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তা। ওই আত্মীয় তাকে দেখে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আত্মীয়ের এ আচরণে তিনি হতাশ হয়ে ফিরে আসেন, চলে যান চট্টগ্রাম কলেজের তালেব আলী চৌধুরীর ক্যান্টিনে। তিনি ওই রাতে তাকে খেতে দেন এবং ক্যান্টিনে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। পরদিন তাকে খরচের জন্য দুই টাকা দেন।
মামলার হুলিয়া নিয়ে তিনি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও রাউজান ও বোয়ালখালীর বিভিন্ন বাড়িতে রাতযাপন করেছেন। পোস্টার লাগাতে পায়ে হেঁটে বোয়ালখালীর গোমদণ্ডী হয়ে কানুনগোপাড়া গেছেন। ওখান থেকে আহল্লা দরবার শরীফ হয়ে গেছেন পটিয়ায়। এভাবে দিনের পর দিন হেঁটেছেন। পকেটে টাকা না থাকার কারণে বহুবেলা অভুক্ত থেকেছেন।
সাক্ষাৎকারে নোমান বলেছিলেন, রাজনীতিতে এক ধরনের অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি এখন টাকার মধ্যে বন্দী হয়ে গেছে। অথচ আমাদের ছাত্রজীবনের রাজনীতি আর এখনকার রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য অনেক। ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে আগের রাজনীতিকরা কাজ করতেন। এখনকার দিনে এসব কল্পনাও করা যায় না। বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষমতা, পদ-পদবি যেন মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মাঝে মাঝে এসব ভেবে খারাপ লাগে। তারপরও আমার মধ্যে প্রতিনিয়ত মানুষের জন্য কিছু একটা করার প্রেরণা জাগে।
১৯৪৫ সালে রাউজানের গহিরা গ্রামে আবদুল্লাহ আল নোমানের জন্ম। সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ এবং ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। গহিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু। সেখানে ৫ম শ্রেণি শেষে কিছুদিন গহিরা হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম শহরের কাজেম আলী হাইস্কুলে।
স্কুলজীবনে ভালো ফুটবল খেলার কারণে রাউজান আরআরএসি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে কাজেম আলী হাইস্কুল থেকে নিয়ে তাদের স্কুলে ভর্তি করায়। সেখান থেকে মেট্রিক পাসের পর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। এ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। রাজনীতিতে জড়ানোর কারণে তাকে অসংখ্যবার কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাগারে থেকে ১৯৬৮ সালের স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এমএ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দেয়ার আগেরদিন সামরিক সরকারের হুলিয়া জারির কারণে তিনি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।
আবদুল্লাহ আল নোমান ১৯৫৯ সাল থেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক, জেলা কমিটির সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান করেন। নগরীর কাজেম আলী হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি স্কুলের বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে কলেজের সাহিত্য ও ম্যাগাজিন সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংগ্রাম পরিষদ’র নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার মাধ্যমে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানকে চট্টগ্রামে সংগঠিত করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন নোমান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাপ’র জাতীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করলে তিনি তার কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হন। জিয়াউর রহমান পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করলে তিনি সিনিয়র সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা সাংগঠনিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি হন। তিনি জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব ছিলেন। এর আগে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে পালন ছিলেন। এছাড়া এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৯৮৬ সালে তিনি কারারুদ্ধ হন।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন, দায়িত্ব পান মন্ত্রিপরিষদে। একই আসন থেকে ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। সেবার মাত্র ১৩ জনের যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, সেখানেও তিনি ছিলেন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হয়ে মন্ত্রিত্ব পান।
এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক আবদুল্লাহ আল নোমানের স্ত্রী অধ্যাপক তাসমিন আরা বেগম। তার একমাত্র ছেলে সাঈদ আল নোমান। একমাত্র মেয়ে ডা. তাজিন নোমান এবং মেয়ের জামাতা ডা. মো. সাদিকুল হক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এ দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।
পূর্বকোণ/ইব