বর্তমানে বিশ্ব এক জটিল ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ সাময়িক বিরতির আবরণে লুকিয়ে থাকলেও, ফিলিস্তিনে প্রতিদিনের হত্যাকাণ্ড থেমে নেই। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এখনও শেষ হয়নি।
এর মধ্যেই ব্রাসেলসে বসেছে ন্যাটো সম্মেলন, যেখানে রাশিয়া ও চীনবিরোধী অবস্থান আরও স্পষ্ট হচ্ছে। আর এই অস্থির পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ শিল্প সংরক্ষণের অজুহাতে যে নতুন শুল্ক আরোপ করেছে, তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি নতুন ঢেউ তুলেছে- যার রেশ বাংলাদেশেও স্পষ্টভাবে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক ব্যবস্থা:
২০২৪ সালের শেষের দিকে এবং ২০২৫ সালের শুরু থেকে, যুক্তরাষ্ট্র চীন, ভিয়েতনাম, মেক্সিকোসহ একাধিক দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছে বা শুল্কহার বাড়িয়েছে। মূলত প্রযুক্তি, ইস্পাত, সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যাটারি, অর্ধপরিবাহী যন্ত্রাংশ এবং কিছু কৃষিপণ্যকে লক্ষ্য করে এই শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এর পেছনে দুটি প্রধান উদ্দেশ্য:
প্রথমত- চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব রোধ করা, বিশেষত টেকনোলজি ও ক্লিন এনার্জি সেক্টরে। দ্বিতীয়ত- নিজেদের উৎপাদন ও চাকরির বাজারকে সুরক্ষা দেওয়া, বিশেষ করে Rust Belt অঞ্চলে নির্বাচনী সুবিধা পাওয়ার আশায়।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব:
এই শুল্ক নীতির ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সরবরাহ চেইনে পুনর্বিন্যাস:
চীনা পণ্য আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলো বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজছে যা মেক্সিকো, ভারত, ভিয়েতনাম এমনকি বাংলাদেশকেও কিছু সুযোগ এনে দিতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি:
শুল্ক বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে, যার কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
বাণিজ্য উত্তেজনা ও জোটবদ্ধতা:
চীন পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটো দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পাশে অবস্থান নিলে নতুন করে বাণিজ্য বিভাজন তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
১. পরোক্ষ সুবিধা: চীন থেকে সরিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কিছু উৎপাদন স্থানান্তরের চিন্তা করতে পারে। বিশেষত পোশাক শিল্প, হালকা প্রকৌশল পণ্য এবং আইটি সেক্টরে কিছু সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
২. ঝুঁকি: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বেশিরভাগ কাঁচামাল এখনো চীন থেকে আসে। চীনা পণ্যের উপর শুল্ক বাড়লে, কাঁচামালের দাম বাড়বে এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। ফলাফল প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হতে পারে।
৩. রপ্তানির সম্ভাবনা ও বাধা: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি শুল্কমুক্ত নয়। কিন্তু ভিয়েতনাম বা মেক্সিকোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) থাকায় তারা তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে। ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে।
৪. রেমিট্যান্স ও প্রবাসী কর্মসংস্থান: যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বিনিয়োগ কমে গেলে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হতে পারে। যা রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৫. মূল্যস্ফীতি ও আমদানি ব্যয়: যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি, ডলার শক্তিশালী হওয়া এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বিঘেœর কারণে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বাড়বে। এতে ভোক্তামূল্য বৃদ্ধি এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ পড়বে।
উপসংহার:
বিশ্ব এখন একাধিক সংকটের সম্মিলিত অভিঘাতে চলছে- যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ, জ্বালানির অস্থিরতা, জলবায়ু সংকট এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা। এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন এক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ যদি কৌশলগতভাবে নিজের অবস্থানকে সাজাতে পারে, তাহলে এই বৈশ্বিক পরিবর্তন থেকে কিছু ইতিবাচক ফল আদায় সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন দ্রুত বাণিজ্য নীতির সংস্কার, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ।
পূর্বকোণ/ইবনুর