উপজেলার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের চর ধুরুং এলাকার নিঃসন্তান দম্পতি মহিব উল্লাহ-দিলোয়ারা। গেল বছর দশেক আগে জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয় তাদের বাড়ি-ভিটা। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমিটুকুও রক্ষা হয়নি। উদ্বাস্তু দু’জনই এখন বাৎসরিক ভাড়ায় পরের ভিটায় ঠাঁই নিয়েছেন। তবে সেখানে লবণাক্ততার কারণে ফসল ফলে না। বাড়ির চতুর্দিকে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু লবণ মাঠ। দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য কেবল নোনা জলই ভরসা।
কুতুবদিয়ার বিভিন্ন এলাকায় দেখা মেলে শত শত পরিবারের এমন সংকটাপন্ন চিত্র। প্রতি বছর কোনো না কোনো পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার লোভে কতিপয় ব্যক্তি ফসলি জমিকে লবণ চাষের উপযোগী করে। এভাবেই ক্রমশ বাড়তে থাকে লবণ চাষের আগ্রাসন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও অস্বাভাবিক লবণাক্ততায় গোটা দ্বীপে পাল্টে যাচ্ছে পরিবেশের গুণগত চরিত্র। তাল, নারকেল, সুপারি ও খেজুর গাছের মতো বিভিন্ন ফলদ বৃক্ষের সমারোহ তেমন চোখে পড়ে না। গাছপালা কমতে থাকায় শহরের মতো নগরে বাড়ছে গরমের তাপমাত্রা। মাটির ঊর্বরতা শক্তি হারানোর ফলে কমছে শস্য উৎপাদন ও খেতখামার। বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছের বিলুপ্তি ঘটেছে।
বাঁশঝাড় বা আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ায় এলাকাভেদে হরেক রকমের পাখির আনাগোনা কমেছে। বিশেষ করে উপজেলার উত্তর-দক্ষিণ ধুরুং, লেমশিখালী ও কৈয়ারবিলে সুপেয় পানি সংকটের ফলে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। বিপন্ন হতে চলছে জনবসতি ঘেরা সবুজ পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতি। লবণের মাঠ বেষ্টিত একেকটি বাড়িভিটা যেন বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। বলা যায়, উপক‚লীয় এই জনপদে লবণের আগ্রাসনে গত দুই দশকের সেই নৈসর্গিক পরিবেশের স্বাভাবিক গতিধারায় এনেছে ছন্দপতন।
দুর্গম এলাকার বেশ কয়েকজন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে সাগরের পানি ঢুকছে লোকালয়ে। কিছু কিছু জায়গায় বসতভিটার লাগোয়া ফসলি জমিকে লবণ মাঠে পরিণত করায় লবণাক্ততার কারণে পুকুরের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বাড়ির আঙিনায় গাছের চারা রোপণ বা শাকসবজি ফলানো যায় না। লবণের প্রভাবে সব মরে যায়। কয়েকটি পুরোনো বাড়ি-ভিটায় সারি সারি নারিকেল গাছের দেখা মিললেও লবণাক্ততায় ফলন বিপর্যয়ের কথা জানায় গৃহস্বামীরা। অনেকেই আক্ষেপ নিয়ে জানায়, কোনো রকম বসবাস করছি! বাড়ি ভিটার আগের সেই সৌন্দর্য বলতে কিছুই নেই।
সচেতন লোকজনের মতে, লবণাক্ততা শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। এখনই কার্যকরী উদ্যোগ বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে আগামী কয়েক দশকে কুতুবদিয়ার অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, শুধুমাত্র বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে প্রতি বছর অন্তত ১০ হেক্টর জমিতে আউশ, আমন ও বোরোর আবাদ হয় না। তাছাড়া বিভিন্ন ফলদ গাছের গোড়ায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ফলন কমে যায়।
স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফরহাদ মিয়া বলেন, দ্বীপ এলাকা হিসেবে কুতুবদিয়ায় লবণের প্রভাব বেশি। শত প্রচেষ্টার পরেও এর একটা সমাধান মিলছে না। লবণাক্ত এলাকায় বসবাসরত মানুষগুলো ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
কুতুবদিয়ার ইউএনও ক্যাথোয়াইপ্রু মারমা জানায়, সাগরের পানি প্রবেশ ঠেকাতে বেড়িবাঁধ সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া লবণাক্ত পানি পরিশুদ্ধ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সুপেয় পানি সাপ্লাইয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ডিসেলিনেশন প্ল্যান্টসহ দ্বীপে চারটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে।
পূর্বকোণ/ইবনুর