সন্দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের বুকে গড়ে ওঠা দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। আগে যোগাযোগ ও সাগরের ভাঙনরোধই ছিলো চার লাখ মানুষের মূল আকাক্সক্ষা। কিন্তু এতদিন কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ছিল সুদূরপরাহত। তবে দেশের পটপরিবর্তনের পর উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে সাগরকন্যা সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপে টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও সীতাকুণ্ড ফেরিঘাট সুরক্ষায় প্রায় ১৩শ ৬২ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প নিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজীর সাইফ আহমেদ বলেন, উত্তর সন্দ্বীপের জেগে ওঠা ভূমি উন্নয়ন ও দক্ষিণ সন্দ্বীপে ভাঙনরোধে এবং সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট থেকে কুমিরাঘাট পর্যন্ত বাঁধ শক্তিশালীকরণে দুটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকল্প দুটি পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। আশা করছি, দ্রুত একনেক সভায় অনুমোদন পাবে।
উড়িরচর ভাঙনরোধে ৭৯৪ কোটির প্রকল্প :
উত্তর সন্দ্বীপে ভূমি উন্নয়ন ও দক্ষিণ উড়িরচরে ভাঙনের ফলে ভূমি হ্রাস রোধকল্পে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। যার প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ডিপিপিতে দেখা যায়, সন্দ্বীপের উত্তরে জেগে ওঠা দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নের ভূমি উন্নয়ন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি, আবাদ-ব্যবহারযোগ্য ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি, বন্যা ব্যবস্থাপনায় সুদৃঢকরণ ও উপকূলীয় যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করার লক্ষ্যে ১০ দশমিক ২২ কিলোমিটার নতুন করে বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
উড়িরচর ইউনিয়নে কৃষি জমি ও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা সুরক্ষায় ৭ দশমিক ৩০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন করা হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এছাড়াও তিন পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠানো (স্লুইস গেট) নির্মাণ ও ১৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার খাল খনন বা পুনর্খনন করা হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে পৌনে দুই কোটি টাকা। এতে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
সন্দ্বীপে ফেরি চলাচলের মাধ্যমে যোগাযোগের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান সন্দ্বীপের উড়িরচরসহ নদী ভাঙনকবলিত এলাকায় বড় পরিসরে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। এরপর সন্দ্বীপ ও সীতাকুণ্ড এলাকায় ফেরিঘাট উন্নয়নে দুটি বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
৫৬ কিমি টেকসই বাঁধ ১০ কিমি :
সন্দ্বীপের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সাগরের তীব্র ভাঙন। ৫৬ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধের মধ্যে টেকসই বাঁধ রয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার। প্রায় তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে শুরু হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। প্রকল্পে ১২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ, ২টি নতুন স্লুইট গেট নির্মাণ ও ৭টি পুরনো স্লুইস গেট মেরামত করার কথা রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছিল।
ঝুঁকিপূর্ণ সন্দ্বীপ উপকূল :
২০২৩ সালে পাউবোর সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে সন্দ্বীপের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল। ৫৬ কিলোমিটারের বাঁধের মধ্যে ৪৫ দশমিক ৩৪ কিমি বাঁধ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সন্দ্বীপ উপকূলরেখা তীব্র ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ২০২০ সালের ৩০টি ঘূর্ণিঝড় বিবেচনা করে স›দ্বীপকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পাউবো সূত্র জানায়, ১৯৬৩ সালে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ১০ মিটার এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলে আঘাত করে। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত উড়িরচরের ১৩ কি.মি. ভূমি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।
সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়াঘাট পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ :
সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট ও ফেরিঘাট থেকে কুমিরা ঘাট পর্যন্ত উপকূলীয় বাঁধ-প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৫৬৮ কোটি ১৭ লাখ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ফেরিঘাট থেকে কুমিরা ঘাট পর্যন্ত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় বাঁধ সংস্কার ও ঘাট উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় দেখা যায়, আকিলপুর থেকে বাঁশবাড়িয়া বাঁধের দুই দশমিক ৪৯ কিমি অংশ শক্তিশালী করা হবে। বাঁধের উপর যানবাহন চলাচল উপযোগী করা হবে। এক কিমি বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ, ৫৯০ মিটার জেটি শক্তিশালী করা।
পাউবো সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা ফেরি সার্ভিসের উদ্বোধনের পর ফেরিঘাটের টেকসই উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এছাড়া ২০২৩ সালে আইডব্লিউএম’র সমীক্ষায় বিষয়টি ওঠে এসেছে।
পূর্বকোণ/ইবনুর