একসময় অন্যসব গ্রামীণ উপজেলার মতো আনোয়ারা উপজেলার নারীরা নিজেদের অধিকার এবং আর্থিক চরম সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করলেও কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঘুরতে শুরু করে এই উপজেলার নারীদের ভাগ্যের চাকা। পরনির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে আত্মনির্ভরশীল হতে শুরু করে এখানকার নারীরা।
এখানকার নারীরা এখন নিজের সাথে সাথে পরিবারের ভরণপোষণেরও দায়িত্ব সামলাচ্ছে। কেইপিজেডে চাকরি করে অনেক স্বামীহারা জননী তাদের ছেলে-মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন দেখছে। এমনকি চট্টগ্রামের অভিশপ্ত যৌতুকের চাহিদা মিটাতেও অনেক নারী এখন নির্দি¦ধায় বেছে নিচ্ছে কেইপিজেডের চাকরি।
জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী এলাকায় ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে কেইপিজেড প্রকল্পটি উদ্বোধন হয়। দীর্ঘ ১০ বছর পর ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে কেইপিজেড পরিবেশের ছাড়পত্র পায়। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে কারখানাটি উৎপাদনে যায়। কেইপিজেডের জায়গার পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ২৫শ একর। মোট বরাদ্দপ্রাপ্ত জমির মধ্যে এ পর্যন্ত ২২৯২ একর।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি কেইপিজেডে বিনিয়োগ করেছে। এসব কোম্পানির কারখানায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে, যার ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক। আগামীতে ১ লাখ শ্রমিকের কর্ম সংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে কেইপিজেড। বিভিন্ন আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কেইপিজেড অবদান রাখছে। শ্রমিকের আয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে মাসিক কোটি কোটি টাকার নগদ সঞ্চালন হচ্ছে। যা এ অঞ্চলসহ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। কেইপিজেডকে ঘিরে স্থানীয়দের ব্যবসা বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। কেইপিজেড পুরোদমে চালু হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হবে।
সকাল-বিকেল আনোয়ারা উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ চাতরী চৌমুহনী, সেন্টার, আনোয়ারা, বটতলী এলাকায় দেখা যায় সূর্যের আলো বের হওয়ার আগে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করে এবং নিজের জন্যও টিফিন নিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ে নারীরা। বিকেলে দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে গাদাগাদি করে বাস-সিএনজি ট্যাক্সিতে চেপে বাসায় ফিরে। আবার অনেকেই চাকরি থেকে ফেরার পথে পরিবারের জন্য বাজার-সদয় করে নিয়ে যায়। নারীরা দুর্বলতা কাটিয়ে নিজেদের পরিবারের কর্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে নিজেদের।
হাইলধর ইউনিয়নের মামুনুর রশীদ নামের এক শ্রমিক বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ ১৫ বছর। একটা মেয়ে আর দু’টা ছেলে সন্তান রয়েছে। মেয়েটা ৭ম শ্রেণিতে আর বড় ছেলেটা ৫ম শ্রেণিতে এবং ছোটো ছেলেটা প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। বিয়ের ৭ বছরের মধ্যে বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে আমি কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে আমার স্ত্রী কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করে। সে থেকে আমার স্ত্রীর রোজগার দিয়ে আমাদের পরিবার এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চলে।
রাবেয়া আক্তার নামের ৩৫বছর বয়সী এক মহিলার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ২০১২ সালের দিকে আমার স্বামী মারা যান। তখন আমার কোলে দুই মেয়ে আর এক ছেলে। আমার বাপের বাড়ির লোকজন বলেছিলো ছেলেমেয়েদের তাদের দাদির কাছে রেখে অন্য জায়গায় বিয়ে বসতে। তবে আমি রাজি ছিলাম না। নিজের মধ্যে একটা জেদ কাজ করছিলো যে, আমি আমার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে তাদের বাবার দায়িত্ব পালন করবো। সেই থেকে আমি কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করি। এখন আমার বড় মেয়ে ইন্টার ১ম বর্ষে আর ছোট মেয়ে ১০ শ্রেণীতে এবং ছেলেটা ৮ম শ্রেণীতে পড়ে। আমি হাল ছাড়িনি কখনো। দিনে কারখানায় কাজ করেছি, রাতে এসে ঘরের কাজ করেছি। আমি আজ পর্যন্ত আমার ছেলেমেয়েদের তাদের বাবার অভাব বুঝতে দিইনি। এখন শুধু একটাই স্বপ্ন মেয়ে দুটোকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করা।
তানিয়া আক্তার নামের আরেক নারী শ্রমিক বলেন, আমার আব্বুর আমরা ৪ মেয়ে। আমি সবার বড়। আব্বু দালান নির্মাণের কাজ করে। কিন্তু আব্বুর একার পক্ষে পরিবারের খরচ সামলিয়ে আমাদের পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই এসএসসির পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করছি। এখন আব্বু আর আমার যৌথ আয় দিয়ে পরিবারের খরচ এবং বোনদের পড়াশোনার খরচ ভালো মতোই চলে। আমি ছাড়া বাকি তিনবোন সবাই পড়াশোনা করে।
কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন নারী শ্রমিকদের সঠিক কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করে কাজ করে। বর্তমানে কেইপিজেডের বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন, যারমধ্যে ৮০% নারী শ্রমিক। আগামীতে ১ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগুচ্ছি।
পূর্বকোণ/ইবনুর