চট্টগ্রাম বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

সর্বশেষ:

লোনা-বর্জ্য পানিতে বিপর্যস্ত কৃষক

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১০ এপ্রিল, ২০২৫ | ১২:০০ অপরাহ্ণ

গেল দুই বছর লবণাক্ত ও শিল্পবর্জ্য পানিতে সেচ দিয়ে কপাল পুড়েছিল বোয়ালখালীর সারোয়াতলী গ্রামের মাঝিরপাড়া বিলের চাষিদের। সেই দুঃখ-হতাশায় এবার বোরো চাষ করেনি সেই ৫ শতাধিক কৃষক। অনাবাদি পড়ে আছে প্রায় ২৫০ একর চাষযোগ্য জমি।

 

এ কথা বললেন সেচপাম্প ম্যানেজার মো. নুরুল আবছার। তিনি বলেন, ধান তো দূরের কথা, খড়ও পাইনি। এবার খালের পানিতে সেচ দিয়ে শীতকালীন সবজিতে লোকসানে পড়তে হয়েছে। বিপর্যস্ত সেচপাম্প ও কৃষকেরা চলতি মৌসুমে বোরো চাষ করেনি।

 

কর্ণফুলীর পানিতে লোনাপানি ছাড়াও শিল্প-কারখানার বর্জ্যপানির কারণে সংকটে পড়েছে বোরো আবাদ। সাগর ও নদী উপকূলীয় এলাকা বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী উপজেলায়ও লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় কয়েক শ কৃষক বোরো চাষে বিমুখ হয়ে পড়েছেন।

 

লবণাক্ত ও শিল্পবর্জ্য পানির সংকট নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএনডিসি ও মৃক্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয় পূর্বকোণের সঙ্গে। মিষ্টিপানির ব্যবস্থা ও খালে বর্জ্য ফেলা বন্ধসহ সংকট সমাধানের আশা জাগাতে পারেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বৃষ্টিপাত না হওয়া, কাপ্তাই লেকের পানি কমে যাওয়ার মতো দায়সারা কথা বলেন।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৯ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমি। গত আমন মৌসুমে আবাদ হয়েছিল এক লাখ ৭৯ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমিতে। চট্টগ্রামে মোট ফসলি জমি রয়েছে তিন লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৭ একর। এরমধ্যে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১০ হাজার হেক্টর।

 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবদুচ ছোবহান পূর্বকোণকে বলেন, উপকূলীয় চার উপজেলায় লবণ সহিঞ্চু ধান ব্রি-৫৫, ৯৭ ও ৯৯ জাতের ধান রোপণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মিঠাপানির ব্যবস্থা করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান হবে।

 

বড় সংকট বোয়ালখালী-পটিয়ায় :

 

কর্ণফুলী নদীতে লবণাক্ততা পানি বেড়ে যাওয়ার বড় সংকটে পড়েছেন বোয়ালখালী ও পটিয়ার উপকূলীয় কৃষকেরা। লবণপানির সঙ্গে এসব এলাকায় শিল্পবর্জ্যরে দূষিত পানি এখন যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। কর্ণফুলী নদী থেকে শিকলবাহা, বোয়ালখালী, রায়খালী খাল দুই উপজেলার বুক ছিঁড়ে বয়ে গেছে। এসব খাল ছাড়াও উপ-খাল দিয়ে ব্যাপক এলাকায় লোনাপানি ছড়িয়ে পড়েছে। অনাবাদি পড়ে রয়েছে কয়েক শ এক ধানি জমি।

 

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বোয়ালখালীর সারোয়াতলীতে কয়েক শ এলাকায় নোনাপানির কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। পুকুর-জলাশয়ের পানিতে চাষাবাদ করে এখন বিপাকে পড়েছেন অনেক কৃষক। বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছেন তারা। একই সমস্যা পাশের উপজেলা পটিয়ার পাঁচরিয়া, কোলাগাঁও, জিরি, কুসুমপুরা, শোভনদণ্ডী, বড়লিয়া ও কেলিশহর ও হাবিলাসদ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকার শত শত কৃষক লবণাক্ততার কারণে চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

 

বোয়ালখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ বলেন, সারোয়াতলী ইউনিয়নের রায়খালী খালের সেচযন্ত্রগুলো লবণাক্ততা ও শিল্পবর্জ্যরে কারণে চালু করা যায়নি। এরফলে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রভাব পড়েছে।

 

পটিয়ার শ্রীমতি ও খরনা খাল ছাড়া প্রতিটি খাল দিয়ে লবণাক্ত পানি আসে। এরমধ্যে চাঁনখালী, মুরালী, শিকলবাহা, মুহুরী, গরুলুটা, পাঁচরিয়া, চন্দ্রকালা খালের পানি অতিরিক্ত লোনাপানির উপস্থিতি রয়েছে।

 

পটিয়ার চরখানাই হাবিলাসদ্বীপ এলাকার সেচপাম্প মালিক ও ইউপি মেম্বার মো. আবুল হাশেম রাব্বু ক্ষোভ প্রকাশ করে পূর্বকোণকে বলেন, গত দুই মৌসুমে আমার ৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর কৃষকদের ক্ষতি আরও কয়েক লাখ টাকা। এ অবস্থায় কী করে চাষ করবো।

 

পটিয়া উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রমজান আলী জানান, পানি পরীক্ষা করতে হচ্ছে না। মুখে নিলেই লবণাক্ততার পরিমাণ বোঝা যায়।

 

কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ৬ ইউনিয়নে শিল্প কারখানার আশপাশে ২১০০ হেক্টর জমি রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে না।

 

পটিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কল্পনা রহমান বলেন, শিল্প-কারখানার নিঃসৃত বর্জ্যরে কারণে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কোন সমাধান মিলছে না।

 

পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারহানুর রহমান বলেন, বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। খালের পানি পরীক্ষার পর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

 

পটিয়ায় ৪৩টি এলএলপি সেচপাম্পের মধ্যে ২৩টি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ (ফ্রাকশনাল) ৪৯৭টি ডিজেলচালিত পাম্পের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হচ্ছে। বোয়ালখালীতে ৩৩টি (এলএলপি, ২টি গভীর নলকূপ ও ৬৫টি ফ্যাকশনাল সেচপাম্প চালু রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু পাম্প সেচ মেশিন দিয়ে আবাদ করা হচ্ছে।

 

শিল্পবর্জ্য :

 

লবণাক্ততা ছাড়াও শিল্পবর্জ্যরে পানিতে বড় ক্ষতি হচ্ছে কৃষকদের। পটিয়ার শিকলবাহা, পাঁচরিয়া ও সার্জেন্ট মহিআলম (আলমখালী খাল) ও ভাটিখাইন মরা খালে শিল্প কারখানার বর্জ্য সরাসরি খালে পড়ে। এছাড়াও বোয়ালখালীর রায়খালীসহ কয়েকটি খালে শিল্পবর্জ্য খালে ফেলা হচ্ছে। বর্জ্যমিশ্রিত পানি খালে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

 

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক মো. মোজাহিদুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, শিল্প-কারখানার বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) মনিটরিং করা হয়। বর্জ্য সরাসরি ফেলার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পটিয়ার একটি শিল্প-কারখানার বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষায় দূষণের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

বোরো চাষ হচ্ছে সেচনির্ভর। বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে চারা রোপণ ও থোড় বের হওয়া পর্যন্ত জমিতে পর্যাপ্ত পানি জমা রাখতে হয়।
সারোয়াতলী কঞ্জুরী গ্রামের কৃষক ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, ৪ লাখ টাকা খরচ করে পুকুর-জলাশয়ের পানি দিয়ে ১২ একর জমিতে আবাদ করেন। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় রায়খালী খালের পানি দিয়েছেন। এতে ধানের চারা লালচে হয়ে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।

 

লবণাক্ততা :

 

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আফছার আলী পূর্বকোণকে বলেন, পানি পরীক্ষার তথ্য নেই। তবে পানি নিয়ে গেলে (এ প্রতিবেদক) পরীক্ষা করে দেবেন।

 

পটিয়া কৃষি বিভাগ জানায়, পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ৭ ডিএস/মিটার। সহনীয় মাত্রা ৬-১০ ডিএস/মিটার। লবণ সহিষ্ণু জাতের ধান ১২-১৪ মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে।

 

সাগর উপকূলীয় এলাকা বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, লবণাক্ততার কারণে সাঙ্গু নদীর পানিতে চাষাবাদ হয় না। উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু ছালেক বলেন, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের চাষিরা লবণযুক্ত সাগর পানি ও সাঙ্গু নদীর পানিতে চাষাবাদ করে না। ছড়া ও গভীর নলকূপের পানিতে চাষাবাদ করেন।

 

বিএডিসি দোহাজারী জোনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাসুদ আলম বলেন, লবণাক্ত ও শিল্পবর্জ্য পানির কারণে অধিকাংশ সেচযন্ত্র চালু করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকেরা। গভীর নলকূপ স্থাপনের সুযোগ বিএডিসির নেই।

 

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন অনুপম কুমার অভি, পূজন সেন ও রবিউল হোসেন)

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট