দেশে লোহার কোন খনি নেই। কিন্তু বছরে লোহার চাহিদা আছে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প এবং আমদানিকৃত স্ক্রাপ থেকে তৈরি বিলেটে মেটানো হয় লোহার চাহিদা। তাই সীতাকুন্ডের সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠেছে সোয়াশ’ জাহাজ ভাঙা শিল্প। এখান থেকে যোগান আসে চাহিদার ৫৫ভাগ লোহা। ফলে এটি পরিণত হয়েছে লোহার ভাসমান খনিতে। সমুদ্রতীরে এই শিল্প গড়ে উঠায় পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হলেও নষ্ট হয় নি কোন আবাদি জমি।
পরিবেশবাদীসহ নানামুখি চাপে এই শিল্পে চলছে মন্দাবস্থা। সোয়াশ’ জাহাজ ভাঙা শিল্পের মধ্যে টিকে আছে ২৫টি। এখন পর্যন্ত ৭টি প্রতিষ্ঠান জাহাজ ভাঙার পরিবেশবান্ধব গ্রীণইয়ার্ড ছাড়পত্র পেয়েছে।আরও ৭টিতে গ্রীন ইয়ার্ড সনদ পাওয়ার কাজ চলছে।কার্যকর ইয়ার্ড থাকছে মাত্র ১৪টি। বাকি ইয়ার্ডগুলো হংকং কনভেনশন অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে গ্রীন ইয়ার্ড না হলে জাহাজ ভাঙার ছাড়পত্র মিলবে না।ফলে দেশে লোহার সংকট তৈরি হবে প্রকট।
বাস্তবতা হলো, একটি ইয়ার্ড গ্রীনে রূপান্তরে দরকার অর্ধশত কোটি টাকা।করোনা পরবর্তী ধাক্কা সামলে গ্রীন ইয়ার্ড করার মতো টাকা অধিকাংশ মালিকের নেই।মুষ্টিমেয় যে কজনের অর্থ ছিল তারা গ্রীন ইয়ার্ড করেছে। অন্য জাহাজ ভাঙা শিল্প মালিকরা পরিবেশবিরোধী নন। তারাও চান পরিবেশসম্মত গ্রীন ইয়ার্ড হোক। তাই তাদের দাবি সময় বাড়ানো হোক । একইসাথে সহজশর্তে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করা হোক। তাদের আশংকা, বাকিদের ব্যাপারে সরকার সহযোগিতা না করলে পাটকলের ভাগ্য বরণ করবে জাহাজাভাঙ্গা শিল্পও।
একটি সিটির মধ্যে ছোট্ট সিটি একেকটি জাহাজ। জাহাজে কি শুধুই লোহাই থাকে? তা নয়। জাহাজে কি নেই, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে তৈজসপত্র, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য সবই পাওয়া যায়। পাওয়া যায় সুন্দর শো-পিস। বার্থরুম ফিটিংস থেকে শুরু করে সার্ভিস বোট, স্পিড বোট পর্যন্ত। এখানে মেলে নানা রকমের নানা সাইজের সিঁড়ি। আরো আছে পিতলের ছোট-বড় দৃষ্টিনন্দন ঘণ্টা। সবমিলিয়ে বলা যায় লোহা ছাড়াও একটি পরিবারের ব্যবহার্য সবকিছুই পাওয়া যায় একেকটি জাহাজে। যার কদর আজ সীতাকুন্ড ছাড়িয়ে দেশজুড়ে। নাগরিকদের চাহিদা বিবেচনায় তাই মহাসড়কের কোলঘেষে সীতাকুন্ডে অংশে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব পণ্যের গুণ-মান ভালো হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে চাহিদাও ।
শুধু তাই নয়, সমুদ্র উপকূলভর্তি যেই এলাকায় জাহাজ ভাঙা শিল্প রয়েছে সেই এলাকা সমুদ্রের ভাঙন থেকে নিরাপদ। বেড়িবাধ নির্মাণের দরকার পড়ছে না ওইসব এলাকায়।জাহাজভাঙ্গা শিল্প এলাকায় ঝুঁকি নেই ভাঙনেরও।সমুদ্রতীরে বেড়িবাঁধ কাম সড়ক থাকছে নিরাপদ। সমুদ্রের উত্তল ঢেউয়ের ধকল যাচ্ছে জাহাজ ভাঙা শিল্পের উপর দিয়ে। ফলে ওইসব এলাকায় সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আঘাত না করায় লোকজন থাকেন নিরাপদে। জোয়ার-জলোচ্ছাস থেকে ক্ষতিমুক্ত খাকছে ফসলি জমি, ঘর-বাড়িসহ নানা সম্পদ।এই অবস্থায় স্থানীয়দের কর্মসংস্থান এবং ব্যবসার সুযোগ তৈরি হওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাধ থেকেও জাহাজা ভাঙা শিল্পের প্রতি মা্য়া স্থানীয়দের।তারা মনে করেন,যতবেশি জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প হবে, তত তাদের ব্যবসা বাড়বে এবং লোকজনের কর্মসংস্থান তৈরি হবে।এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে জনআকাংখা বিবেচনায় এই শিল্প টিকিয়ে রাখার পক্ষে সীতাকুন্ডবাসী।
তবে পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা পরিবেশ দূষণ ও দুর্ঘটনা নিয়ে। ইনিস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে জাহাজ ভাঙা শিল্পে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন ১৪২জন শ্রমিক। আহত হয়েছেন অনেকে। পরিবেশবান্ধব হতে আগ্রহী ইয়ার্ড মালিকরাও। তবে কম-বেশি দুর্ঘটনায় মৃত্যু সব কারখানায় ঘটে। অস্বাভাবিক মৃত্যু কেউ চায় না। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর মালিককে প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য ৭ লাখ ক্ষতিপূরণ দেয়া ছাড়াও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। তারাও দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু চান না।
কালকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক শিপন চৌধুরী বললেন, জাহাজাভাঙ্গা শিল্পের পরিবেশ আগের চাইতে অনেক উন্নতি হয়েছে। দুর্ঘটনাও আগের চাইতে অনেক কমেছে। গেলো বছর দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গ্রীন ইয়ার্ড এস এন কর্পোরেশনে দুর্ঘটনায় ৬ জন মারা যায়। ওটা এড়াতে পারলে দুর্ঘটনা শূন্যের কোটায় নেমে আসতো। লোহার চাহিদা বিবেচনায় নীতিনির্ধারকরা সুনজর দিলে এই শিল্প রক্ষা পাবে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) বলছে, ব্যাংকগুলো শুধু জাহাজ কেনার জন্য স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয় এই খাতকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে লাল তালিকায় রাখায় শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের উন্নয়নে ঋণ দেয় না। তাই আর্থিক সহায়তার অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধব হতে পারছে না। একটি ছোট প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশবান্ধব করতে হলে ৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন। মুনাফার মাধ্যমে এই টাকা তুলতে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। এই খাতে বিনিয়োগে আছে অনিশ্চয়তাও ।
বিশ্বের বড় ১০ লৌহখনির ৮টিই অস্ট্রেলিয়াতে। আমাদের লোহার খনি নেই বিধায় জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প ও আমদানিকৃত স্ক্রাপ’র ওপর নির্ভরশীল। ২০২৩ সালে ভাঙ্গার জন্য জাহাজ আমদানি হয় ১৭০টি। তাতে লোহা পাওয়া যায় ৩২ লাখ ৩২ হাজার ৫৯৩ মেট্রিক টন। পক্ষান্তরে ২০২৪ সালে ভাঙ্গার জন্য জাহাজ আমদানি হয় ১৩০টি। তাতে লোহা পাওয়া যায় ২৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৩১ মেট্রিক টন। এক বছরের ব্যবধানে জাহাজ আমদানি কমেছে ৪০টি। চলতি বছরের এ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৪৬টি।বিপরীতে তুরস্ক ও পাকিস্তানে ভাঙ্গার জাহাজ আমদানি বেড়েছে দ্বিগুণের মতো। এখানে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত।তিন শতাধিক স্টিল রি-রোলিং মিলের প্রধান কাঁচামাল পুরনো জাহাজের স্ক্র্যাপই।
মহাসড়কের সীতাকুন্ড অংশে এক সময় ৭৭টি জুট মিল ছিল।লাখো শ্রমিকের কর্মসংস্থান ছিল।সব জুট মিল এখন বন্ধ।দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে যেভাবে পাটকল বন্ধ হয়েছে,সেভাবে জাহাজ ভাঙা শিল্প বন্ধের ষড়যন্ত্র চলছে মনে করেন ইয়ার্ড মালিকরা। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ তাদের। এই অবস্থায় সরকারকে এগিয়ে আসা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিবেশবান্ধব গ্রীন ইয়ার্ড করার সময় আরো বাড়ানো উচিত মনে করেন শিল্প মালিকরা।
বিবিএস’র সবশেষ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বেকার বেড়েছে দেড় লাখ। ২০২৪ সালে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৫ লাখ।গত বছর বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এই অবস্থায় শিপব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধ হলে বেকারের সংখ্যা আরো বাড়বে।সুতরাং শিপব্রেকিং ইয়ার্ডকে অভিশাপ না ভেবে আশীর্বাদ ভাবাই হবে সবার জন্য মঙ্গলজনক।
লেখক : ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম
পূর্বকোণ/এএইচ