মাধ্যমিক শেষ করার পর প্রথমবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নাম শুনেন চট্টগ্রাম কলেজের তোফায়েল আহমেদ। তখন থেকেই স্বপ্ন বুনেন বড় হয়ে বুয়েটে পড়াশোনা করে প্রকৌশলী হওয়ার। নানা প্রতিকূলতায় অনেকটা কঠিনই ছিল সেই স্বপ্নযাত্রা। নিজ চেষ্টায় প্রকৌশলবিদ্যায় দেশসেরা প্রতিষ্ঠান বুয়েটে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন তোফায়েল। তার অনন্য সেই গল্প পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন দৈনিক পূর্বকোণের নিজস্ব প্রতিবেদক আরাফাত বিন হাসান ।
পুরোনাম মোহাম্মদ তোফায়েল আহমেদ হলেও ডাকনাম নাঈম। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মনপাড়ার পূর্ব চান্দিপুরে। তবে জন্ম ও ছোটবেলা কেটেছে নগরীর হালিশহর এলাকায়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চট্টগ্রাম রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ছিলাম। মাধ্যমিক শেষ করেছি সরাইপাড়া সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এইচএসসিতে ছিল চট্টগ্রাম কলেজে। আমরা তিন-ভাই বোন, দুবোন আমার বড়। তাদের একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন, অন্যজন স্নাতক তৃতীয় বর্ষে।
পড়াশোনায় অনলাইন নির্ভরতা
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে গড়পড়তা শিক্ষার্থী ছিলাম। এসএসসির পর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তির সুযোগ পাই, কলেজে ভর্তির সময় প্রথম বুয়েটের বিষয়ে জানতে পারি। তখন থেকেই আমি অনলাইনে সবকিছু খুঁজতে থাকি। তখন থেকে অনলাইন নির্ভর হই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব ছিলাম। অধিকাংশ পড়াশোনা ইউটিউব নির্ভর ছিল। অনলাইনে ক্লাস নেন এমন কোনো টিচার নেই, যার ক্লাস অমি করিনি। বিশেষ করে হিমেল স্যার নামের একজন আছেন, ইউটিউবে তার ফ্রি ক্লাসগুলো আমরা খুব কাজে এসেছে। শেষ দিকে এসে দুটো কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছি, সেগুলোতেও অনলাইন-অফলাইন দুভাবেই ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতটাই সরব ছিলাম যে প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা এসবের পেছনে ব্যয় হতো। তবে আমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। আমি ঠিক করে নিতাম কতক্ষণ ফেসবুকিং করব বা টেক্সটিং করব, এর বেশি সময় ব্যয় করতাম না।
পড়াশোনার পাশাপাশি চলত খেলাধূলা-গেমিং
কলেজে ভর্তির পর সিনিয়রদের কাছে শুনেছি দৈনিক ১৫-১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হবে। এটা শুনে অনেকটা ভয়ই পেয়েছিলাম। শুরুর দিকে দেখি সবাই বিভিন্ন কোচিং-টিউশনে দৌড়াচ্ছে, বাসায় টিচার রেখে পড়াশোনা করছে। তখন কিছুটা চিন্তা হয়েছিল ঠিকই, এর পরপরই কলেজ শুরুর ৭-৮ মাসে কোনোদিকে না তাকিয়ে দৈনিক ১১-১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করে এইচএসসির সিলেবাস শেষ করি। এরপর নির্ভার হয়ে যাই, পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলা, গেমিং, মুভি দেখা এসব শুরু করি। তাড়াতাড়ি সিলেবাস শেষে করায় বেশ কয়েকবার রিভাইজ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে, এটা খুব বেশি কাজে এসেছে। এইচএসসি পরীক্ষা বা এডমিশনের সময় খুব বেশি প্রেশার ছিল না।
সরব ছিলাম আন্দোলনে
আন্দোলনের সময় মাঠেই ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যেতাম নিয়মিত। তখন পড়াশোনা করতে পারিনি। আসলে তখন পড়ার চেষ্টা করলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। তাই পুরো দেশের শিক্ষার্থীদের মতো সংগ্রামের দিনগুলোতে আমিও পড়াশোনার বাইরে ছিলাম। পরে এইচএসসির পর ভর্তি প্রস্তুতির সময় ফের পড়াশোনা শুরু করি।
প্রতিকূলতায় হাল ছাড়িনি
কলেজের প্রথম বর্ষে থাকতেই এডমিশনের অনলাইন কোচিংগুলোতে বেনামে পরীক্ষা দিতাম। বেশিরভাগ সময় কিছুই পারতাম না। মাঝেমধ্যে পরীক্ষা ভালো হতো। ওটা উপভোগ করতাম, ভালোও লাগত। বলতে গেলে আমার পথে অনেক বাধা ছিল। আর্থিক সীমাবদ্ধতা তো ছিলই। আর্থিক সীমাবদ্ধা দূর করতেই অনলাইনে পড়াশোনা করতাম। বেশিরভাগ বিনামূল্যের কোর্সে পড়েছি। তবে অল্প টাকায় কয়েকটি পেইড কোর্সও কিনেছিলাম। সেগুলো কাজে এসেছে। শুরুর দিকে অনেককিছুই পরতাম না। পরীক্ষা ভালো না হলে মন খারাপ হতো। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। চেষ্টা করে গেছি ধারাবাহিকভাবে।
চেষ্টা করতাম পরিবারের ওপর চাপ না দিতে
অনেকে বলেন সাইন্সে পড়াশোনা ব্যয়বহুল। এটা যেমন পুরোপুরি মিথ্যা না, তেমনি পুরোপুরি সত্যও না। আমি কখনও পরিবারের ওপর চাপ দিইনি। সবসময় চেষ্টা করেছি যেন বাবা-মা’র ওপর চাপ না পড়ে। নিজে বৃত্তির টাকা পেতাম। আবার কোচিংয়ের পরীক্ষায় ফার্স্ট হলে একটা প্রাইজমানি পেতাম। তাছাড়া আমি খরচও খুব কম করি। সব মিলিয়ে কষ্ট হয়নি। আমি অকেজো কিছুই কিনিনি, কারণ প্রয়োজনীয় সবকিছুই অনলাইনে পাওয়া যায়।
রুটিন মেনে নয়, টার্গেট ঠিক করে পড়েছিলাম
অনেকেই ভর্তি প্রস্তুতির পড়াশোনা নিয়ে অনেক কিছু বলেন। ১৫-১৬ ঘণ্টা পড়াশোনার কথা বলেন। আমি এসব অনুসরণ করিনি। দৈনিক টার্গেট ঠিক করে পড়েছি। টার্গেট শেষ করতে কোনোদিন ৩ ঘণ্টা লেগেছে তো কোনোদিন ১০ ঘণ্টা লেগেছে। গড়ে ৫-৬ ঘণ্টার বেশি হবে না।
কেমন ছিল ফলাফল হাতে পাওয়ার মুহূর্ত
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) আমি ৬১ তম হয়েছিলাম। কিন্তু প্রস্তুতি অনুযায়ী আশা করেছিলাম ১-১০ এর মধ্যে থাকব। তাই মন খারাপ হয়েছিল। বুয়েটেও আশা ছিল ১-১০ এর মধ্যে থাকব। প্রথম হয়ে যাব ভাবিনি। এটা আল্লাহ’র দয়া। ফলাফল দেখে পুরোপুরি বিশ্বাস করার আগে কয়েকবার ক্রসচেক করেছি। খুশিতে লাফানো শুরু করেছিলাম। আম্মুকে বলার পর আম্মুও খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। বাবা কাজর সুবাদে বাহিরে থাকেন, রেজাল্টের পর তিনি এখনও বাসায় আসেননি। তবে ফোনে তাকে রেজাল্ট জানানোর পর সবার সামনে চিৎকার শুরু করেছিলেন খুশিতে। আমার বোন, শিক্ষক সবাই খুশি।
নতুনদের জন্য তোফায়েলের বার্তা
বেশি পড়ার খুব বেশি দরকার নেই। কিন্তু ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। কলেজের শুরুতে সিলেবাস শেষ করলে রিভাইস করার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। পড়ার চেয়ে অনুশীলন জরুরি। বার বার অনুশীলন করলে ফল পাওয়া যাবে।
পাশে ছিলেন বাবা-মা তবে নিজের গাইড ছিলেন নিজেই
বাবা-মা-বোনসহ সবাই পাশে ছিলেন। বাবা তো বাইরে থাকেন। কিন্তু আম্মু আমার পরিশ্রমটা দেখেছেন। মাঝেমধ্যে এমন হতো যে পড়াশোনা করতে করতে রাতের তিনটা-চারটা বেজে গেছে। আম্মু আলো জ্বলতে দেখে রুমে এসে আমাকে ঘুমিয়ে যেতে বলতেন। সবকিছুতে সবাই সাপোর্ট দিতেন। কোনো পরীক্ষায় খারাপ করলে মন খারাপ হতো, তখন আম্মু সাহস দিতেন।
এগুতে চান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে
স্কুলে পড়াশোনার সময় এটা-ওটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে ভালো লাগতো। ক্যালকুলেটর, ঘড়ি বা পাখা- এসব অকেজো হয়ে গেলে মেরামত করার চেষ্টা করতাম। অবশ্য খুব একটা সফল হতাম না। বড় হতে হতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স এবং অটোমোবাইলসে আগ্রহ তৈরি হয়। তাই কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করব। তবে মূলত একজন ভালো মানুষ হতে চাই। পড়াশোনা করে দেশের কাজে আসতে চাই।
মা বললেন, ছেলে যেন দেশের কাজে আসে
তোফায়েলের মা মিনা বেগম ছেলের ফলাফল নিয়ে বলেন, চুয়েটের রেজাল্ট শুনে সে মন খারাপ করেছিল। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন বুয়েটের পরীক্ষা ভালো হয়েছে। তার ফলাফলে আমরা সবাই খুশি। পড়াশোনা শিখে সে যেন ভালো মানুষ হয়। সবার কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই, সে যেন বড় হয়ে দেশের কাজে আসে।
পূর্বকোণ/জেইউ