চট্টগ্রাম বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে করণীয়

ড. মো. আবু তাহের

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১২:১৪ অপরাহ্ণ

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানপরবর্তীতে ‘ডক্ট্রিন অফ নেসেসিটি’ অনুসারে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর সর্বত্রই রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। মূলত সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। কিছু সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়েছে; অন্যান্য সংস্কার কাজগুলো অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান হবে-এ আশায় রইলাম।

 

 

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে চার কোটির অধিক শিক্ষার্থী ও প্রায় ১৩ লাখ শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত শিক্ষাব্যবস্থাটির সংস্কার অতীব জরুরি। শিক্ষাপরিবারের একজন সদস্য হিসেবে শিক্ষকের দায়িত্বের জায়গা থেকে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের নিমিত্তে কিছু প্রস্তাব রাখছি।

 

১) প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা এবং উচ্চশিক্ষার সমন্বয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গঠিত। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন, টেকসই ও কর্মসংস্থানমুখি করার নিমিত্তে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষাপ্রশাসক ও শিক্ষাগবেষকের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী শিক্ষাকমিশন গঠন করা প্রয়োজন। উক্ত কমিশন মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার টিচিং-লার্নিং, কারিকুলাম, মূল্যায়নপদ্ধতি ইত্যাদি মনিটরিং করে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। মন্ত্রণালয় সেই মোতাবেক কার্যক্রম গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট অফিস যেমন ইউজিসি, শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক তা বাস্তবায়ন করবে।

 

২) বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পঠন পাঠনকেন্দ্রিক ক্লাস-পরীক্ষা মুখ্য; কাঠামোগত ত্রুটির কারণে গবেষণা হয়ে থাকলে গৌণ। অথচ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে গবেষণা-উদ্ভাবনের কোন বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল (এনআরসি) গঠন করা অতীব জরুরি। গঠিত এনআরসি প্রণীতব্য গবেষণা নীতিমালা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ইস্যুভিত্তিক প্রস্তাবনা আহবান করবে। প্রাপ্ত গবেষণা প্রস্তাবনাসমূহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুইজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে রিভিউ করে গবেষণা প্রস্তাবগুলো নির্বাচন করবে। ফলে দেশে একটি গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যা প্রকারান্তে শিক্ষামান উন্নয়নসহ বিশ্ব রেংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সুনিশ্চিত করবে।

 

৩) যে কোন স্তরের মানসম্পন্ন পঠন পাঠনের জন্য দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার নিমিত্তে একটি আদর্শ প্রক্রিয়া যেমন লিখিত পরীক্ষা, ডেমোনস্ট্রেশন ও মৌখিক পরীক্ষা ফলাফল যোগ করে সমন্বিত স্কোরের ভিত্তিতে মেরিট লিস্ট অনুযায়ী শিক্ষক নির্বাচন করতে হবে। উপরন্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্ণিত নিয়োগ প্রক্রিয়ার পয়েন্টের সাথে স্নাতক- স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল, গবেষণা প্রবন্ধ, কনফারেন্স পেপার, পিএইচডি (যদি থাকে) ইত্যাদি বিষয়াদি অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ‘মাল্টিপল ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ’ পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে।

 

৪) ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।

 

৫) কর্মমুখী ও চাহিদাভিত্তিক শিখনকার্যক্রম জন্য শিল্পের সাথে শিক্ষাঙ্গনগুলোর সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তে সরকারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।

 

৬) চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবেলায় ও কর্মবাজারে প্রবেশের জন্য যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন সে অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষায়তনে যুগ উপযোগী শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার ওপর জোর দিতে হবে। উপরন্ত, বর্তমানে কারিগরি স্কুল, টেকনিক্যাল কলেজ, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটসমূহে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী দক্ষতাভিত্তিক মানব উন্নয়ন অতীব জরুরি।

 

৭) শিক্ষায়তনের বিদ্যমান আইন, বিধিবিধানসমূহ যথাযথ প্রয়োগপূর্বক সব মত ও পথের শিক্ষার্থীদের সহঅবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া হলসমূহে যতটুকু সম্ভব মেধাবৃত্তিক আসন বন্টন করে সৃজনশীল ও মননশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে আনন্দময় করে তুলতে হবে। এজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানও জরুরি। তবে শিক্ষায়তনের আইনগত কাঠামোর আওতায় বিধিবিধান প্রয়োগ করে ছাত্র- শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে।

 

৮) প্রত্যেক স্তরের শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে যাতে শিক্ষার মানোন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য কোন ইনস্টিটিউট/একাডেমি নাই। হেকেপ প্রকল্পের আউটকাম হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি (ইউটিটিএ) প্রতিষ্ঠার করার কথা উল্লেখ থাকলেও অদ্যাবধি তা হয়নি। উচ্চশিক্ষার মানউন্নয়নের জন্য উক্ত একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি। উক্ত প্রশিক্ষণ একাডেমিতে একাডেমিক (কারিকুলাম, কো কারিকুলাম, এক্সট্রা কারিকুলাম), প্রশাসনিক, আইন-সংবিধি, আর্থিক নিয়মাবলী, তথ্য প্রযুক্তি, গবেষণা- প্রকাশনা-উদ্ভাবন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে কমপক্ষে চার মাস মেয়াদী একটি ফাউন্ডেশন ট্রেনিং চালু করলে তা উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।

 

৯) ক্লাসে পাঠদান নিয়মিতকরণ ও পাঠদান প্রক্রিয়াকে উপভোগ্য, আনন্দদায়ক ও অনুসন্ধিৎস্যময় করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

১০) তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি এবং তাদের মূল্যায়ন রিপোর্ট অভিভাবকদের অবহিতকরণসহ শিক্ষায়তনের আপডেট তথ্যাদি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

 

 

মূলত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য জনসাধারণের মতামত তৈরীর জন্য ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে বর্ণিত প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করা হলো। এই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশেজনদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় অতীব জরুরি। উক্ত মিথস্ক্রিয়ায় শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে বহু মত থাকা স্বাভাবিক। তবে বহুমতকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমন্বিতভাবে ঐক্যমতে পৌঁছে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। আশা করি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এর নেতৃত্বে শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো হবে, যা সত্যিকার অর্থেই শিক্ষাঙ্গনগুলো জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে অনেকাংশে সহায়ক হবে।

 

 

লেখক : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, ঢাকা; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট