চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

চট্টলবীরের সন্তানই কি সৌভাগ্যের ‘বরপুত্র’

চট্টগ্রাম-৯ (বাকলিয়া-কোতোয়ালী)

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ | ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে মিশেছে চট্টগ্রাম-৮ ও ১০ আসনের সীমারেখা। দুই আসনের প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে পুরো এলাকা, দেখা গেলো ভোটের উৎসব।

গন্তব্য চট্টগ্রাম-৯ (বাকলিয়া-কোতোয়ালী) আসন। যেটিকে চট্টগ্রামের ভিআইপি বা মর্যাদাপূর্ণ আসন বলা হয়। কেউ কেউ ‘সৌভাগ্যে’র আসনও বলেন। কারণ এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী জয়ী হয়, সেই দল রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তাই সকলের নজর থাকে সৌভাগ্যের এই আসন নিয়ে।

 

বহদ্দারহাট মোড় থেকে ট্যাক্সিযোগে শাহ আমানত সেতু গোলচত্বর পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে চোখ আটকে যায়। রাস্তা বা অলিগলিতে পোস্টার-ব্যানারের আধিক্য নেই। কালামিয়া বাজার, বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় নৌকা প্রতীকের কিছু পোস্টার-ব্যানার চোখে পড়ে।

 

দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার খ্যাত শাহ আমানত সেতু এলাকায়ও একই দৃশ্য দেখা গেলো। তবে নৌকার পোস্টার-ব্যানারের ফাঁকে ফাঁকে ন্যাপের মিটল দাশগুপ্তের কুঁড়েঘর, ওয়াহেদ মুরাদের চেয়ার ও তৃণমূল বিএনপির সুজিত সরকারের সোনালী আঁশ প্রতীকের পোস্টার চোখে পড়ে।

 

গোলচত্বর এলাকায় কথা হয় পানের দোকানি কামাল উদ্দিন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. মাসুদ, দুই ট্যাক্সিচালক হেলাল ও আবু রেজার সঙ্গে। তাদের কাছে জানতে চাইলাম, ‘ভোটের পরিবেশ কেমন মনে হচ্ছে?’ আমতা আমতা করে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘পরিবেশ তো আপনি দেখতে পারছেন।’ ‘কারা ভোটে দাঁড়িয়েছেন’- এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘নৌকার প্রার্থী নওফেলের পোস্টার-ব্যানার, মাইকিং ও প্রচার-প্রচারণা চলছে। অন্য প্রার্থীদের তেমনটা দেখা যায়নি।’

 

দেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জেও একই দৃশ্য চোখে পড়ে। ব্যবসায়ী, শ্রমিক-কর্মচারী ও দোকানিরা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। ভোটের প্রতি যেন বড় ধরনের আগ্রহ নেই। বহদ্দারহাট থেকে খাতুনগঞ্জ ঘুরে শুধু ভোটের আমেজ দেখা যায় ৩৫নং বক্সিরহাট ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ওই ওয়ার্ডের ১৫-২০ জন নেতাকর্মী ভোট নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি, মিছিল, প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগের শলা-পরামর্শ করছেন।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, কমার্স কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক এজিএস মামুনুর রশিদ মামুন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক লিটন রায় চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক প্রশান্ত ভট্টাচার্য ও ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মান্না বিশ^াস দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ভোটের কর্ম-পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। পোস্টার-ব্যানার ও ভোটের আমেজ নিয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভোটারদের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। ভোটকে উৎসবমুখর করে তুলতে দলীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন।

 

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অলিগলি ঘুরে ঘুরে ভোটারদের কাছে যাচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।

 

তবে বাণিজ্যিক পাড়া থেকে বের হয়ে আন্দরকিল্লা, জামালখান এলাকায় এসে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছাড়াও অন্যান্য প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানার চোখে পড়ে। ইসলামী ফ্রন্টের মোমবাতি ও ইসলামিক ফ্রন্টের চেয়ার প্রতীকের দুটি পৃথক প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।

 

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৫-২৩ এবং ৩১-৩৫নং ওয়ার্ড নিয়ে চট্টগ্রাম-৯ সংসদীয় আসন গঠিত। দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালত ভবন, চট্টগ্রাম কারাগারসহ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র এই আসনের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও সুফিসাধক হজরত আমানত শাহ (রহ.) ও হযরত বদর শাহ’র (রহ.) মাজার শরিফও এই আসনের অন্তর্ভুক্ত। আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্রের কারণে চট্টগ্রাম-৯ আসনকে চট্টগ্রামের ‘সৌভাগ্যে’র আসন বলা হয়।

 

জনশ্রুতি রয়েছে, এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করেন, সেই দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জয়লাভ করেছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী। এছাড়াও এই আসন থেকে নির্বাচন করে বর্ষীয়ান নেতা আওয়ামী লীগের এমএ মান্নান, বিএনপির আবদুল্লাহ আল নোমান, আওয়ামী লীগের নূরুল ইসলাম বিএসসি ও বর্তমান সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নির্বাচিত হয়ে সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। এ আসন থেকে জয়ী হয়ে মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি শুধু জাপার জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।

 

এ আসনে প্রার্থী আছেন নয়জন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী সানজীদ রশীদ চৌধুরী (লাঙ্গল), ইসলামী ফ্রন্টের আবু আজম (মোমবাতি), ইসলামিক ফ্রন্টের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার), ন্যাপের মিটল দাশগুপ্ত (কুঁড়েঘর), কল্যাণ পার্টির মোহাম্মদ নূরুল হুসাইন (হাতঘড়ি), তৃণমূল বিএনপির সুজিত সরকার (সোনালী আঁশ)।

 

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নিজেকে নির্ভার মনে করছেন না। নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অলিগলি। ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ভোট চাইছেন। সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছেন। উন্নয়নের ধারাবারিকতা অব্যাহত রাখতে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রত্যাশা করছেন। নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামের উন্নয়নে শেখ হাসিনা যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নে নিবেদিত হবো।’

 

খাতুনগঞ্জ আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতা জয়নাল আবেদীন মিন্টু বলেন, দেশের অন্যতম এই প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রে প্রতিদিন অন্তত হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পায় এখান থেকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কল্যাণে বড় কোন প্রকল্প নেওয়া হয়নি। প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতায় কোটি কোটি টাকার পণ্য পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হলেও তা ব্যবসাবান্ধব উপযোগী পরিকল্পনা করা হয়নি। জোয়ার-ভাটানির্ভর হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ, জলাবদ্ধতা নিরসন, রাস্তাঘাট প্রশস্তকরণ ও পরিকল্পনা উন্নয়নের মাধ্যমে বাণিজ্যবান্ধব খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই গড়ে তোলার দাবি ব্যবসায়ীদের।

 

এই আসনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হচ্ছে বাকলিয়া। মাদক, সন্ত্রাস ও ইভটিজিং বড় সমস্যা। শহরের বাসিন্দা হয়েও অনুন্নত রাস্তাঘাট রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট। বর্ষা মৌসুমে বৃহত্তম বাকলিয়া পানিতে ডুবে থাকে। বর্তমানে বারৈপাড়া খাল খনন প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। খালটি খনন করা হলে জলাবদ্ধতা থেকে অনেকটা রেহাই পাবে বাকলিয়াবাসী।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট