চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর অভিযোগ, ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে। আমার কর্মী-সমর্থদের মারধর ও ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। প্রচার ক্যাম্প ও গাড়ি ভাঙচুর করছে। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় হচ্ছে উৎসবমুখর নির্বাচন। কিন্তু নৌকার প্রার্থী-সমর্থকেরা সংঘাতময় ও সহিংস করে তুলেছেন। এতে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
একই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর অভিযোগ, ‘হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ভোটের আগে থেকেই ওসি নেজাম উদ্দিন ও এসআই সঞ্জয়কে নিয়ে প্রশাসন নিজের মতো সাজিয়ে রেখেছেন। তারা এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে। যুবলীগ নেতা জমিরকে জামিনের পর আবার গ্রেপ্তার করেছে। যা সুষ্ঠু ভোটের অন্তরায়।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন দুই প্রার্থী।
গতকাল (মঙ্গলবার) সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম জেলার সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এলজিইডি মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিইসির কাছে ভোটের মাঠে প্রার্থী-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ তুলে ধরেন। নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনায় শঙ্কা ও আতঙ্কের কথা জানান প্রার্থীরা। বেশির ভাগ অভিযোগ ছিল, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ঘিরে। নির্বাচনে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানিছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা।
চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনে ১২৫ জন প্রার্থী রয়েছেন। প্রার্থী ও তাদের প্রস্তাবক-সমর্থকদের নিয়ে এই সভা করেছেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল।
পাঁচটি আসনে প্রচার-প্রচারণায় সংঘাত-সংঘর্ষ ও সহিংসতায় ভোটের মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ও চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া- লোহাগাড়া) আসন নিয়ে বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন ভোটাররা। পটিয়ায় নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরী (ঈগল) এবং সাতকানিয়ায় নৌকার প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবকে (ঈগল) প্রার্থীদের ঘিরে উত্তাপ-উত্তেজনা বিরাজ করছে। চার প্রার্থীই নির্বাচন কমিশনে ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী বলেন, চরতী ইউনিয়নে প্রচারণায় আমার সহধর্মিণীসহ নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করা হয়েছে। কিন্তু মূলহোতাদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। এছাড়াও আমার প্রচারণায় বাধা ও হুমকি প্রদান করছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর (এমএ মোতালেব) সমর্থকেরা। এসব বিষয় জানিয়ে সিইসির কাছে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠানের দাবি করেছেন। তবে এসপি এ মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা বলেছেন। মূল আসামিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছেন।
একই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেবের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সাতকানিয়ার পৌর মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের। তিনি বলেন, ‘চরতীতে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবু রেজা নদভীর সমর্থকদের উপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানাই। কিন্তু এই ঘটনায় জড়িত নিরীহ মানুষকে মামলায় জড়ানোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’ সিইসির কাছে তিনি অভিযোগ করেন, আমিন নদভী নামে পাকিস্তানি এক নাগরিক সহিংসতা এবং হামলার পরিকল্পনা করছে। আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের এনে নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টি, প্রাণনাশ ও নাশকতার পরিকল্পনা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে ইসলামী ফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী স উ ম আবদুস সামাদ (মোমবাতি) জানান, ‘নির্বাচনে আমরা উৎসব চাই। যুদ্ধ চাই না। দুই প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা (আ. লীগ প্রার্থী নজরুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল জব্বার) ভোটের মাঠ সংঘাত-সংঘর্ষময় করে তুলেছে। বিভিন্ন এলাকায় আমার পোস্টার-ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেছে। নির্বাচন কমিশনকে এসব কথা বলেছি। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ^াস দিয়েছেন ইসি।’
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গিয়াস উদ্দিন (ঈগল) নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ এ পর্যন্ত ভালো রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে তার নির্বাচনী অফিস ভাংচুর, পোস্টার ছেঁড়া ও প্রশাসনকে নিজেদের মতো করে ব্যবহারের অভিযোগ করেন করে তিনি।
চট্টগ্রাম-১০ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ মাহমুদ (কেটলি) বলেন, ‘পুরো নির্বাচনী এলাকা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পোস্টার-ব্যানারে ঢেকে রেখেছেন। অন্য প্রার্থীদের জন্য খালি জায়গা রাখেননি।’
এই অভিযোগ বিষয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘কারো জন্য খালি জায়গা রাখতে হবে এমন কোনো বিধান রয়েছে কিনা আমার জানা নেই।’ তবে তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী (ঈগল) তার কর্মীদের ধাওয়া, মারধর ও প্রস্তাবকের হাত ভেঙ্গে দেওয়ার অভিযোগ করেন।
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহজাহান চৌধুরী (কেটলি প্রতীক) বলেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যত্যয় ঘটলে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। ভোটার ও পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ইসির কাছে দাবি করেছি। একই সঙ্গে ভোটকেন্দ্রেই ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণার দাবি করেছি। তবে কোনো ধরনের অভিযোগ করেননি তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী মো. নাজিম উদ্দিন (সোনালী আঁশ)।
চট্টগ্রাম-১১ (পতেঙ্গা-বন্দর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম এ লতিফ বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগেও মানুষের মধ্যে ভোটদানের এই উৎসাহ দেখিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ দেখা যেতো না। ভোটারদের কেন্দ্রে আসার পথ সুগম করার জন্য দাবি করেছি। কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
তবে একই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে পোস্টার-ব্যানার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ করেন।
চট্টগ্রাম-৮ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ (লাঙ্গল) বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আশ^াস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই এই নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। একই কথা বললেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচন কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ইসিকে বলেছি। পেশীশক্তিমুক্ত অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দাবি করেছি। ইসি আশ্বাস দিয়েছেন।’
চট্টগ্রাম-৪ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী এসএম আল মামুন বলেন, সোহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। এলাকার আইনশৃঙ্খলাও সন্তোষজনক রয়েছে।
ইসলামিক ফ্রন্টের প্রার্থী আবুল বাশার মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন চট্টগ্রাম-১০ ও ১১ দুটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পরিবেশ ভালো রয়েছে। প্রচার-প্রচারণায় ভয়-ভীতি নেই। তবে কিছু শঙ্কা রয়েছে। ভোটে জনআস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইসিকে অনুরোধ করেছি।
পূর্বকোণ/পিআর