চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

৫ হাজার টাকার কম্পিউটারে বদলে গেছে জীবন

কম্পিউটার না থাকায় প্রথমে মোবাইল দিয়েই এইচটিএমএল, সিএসএস শিখেন

মরিয়ম জাহান মুন্নী

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ২:৩০ অপরাহ্ণ

বয়স যখন মাত্র আট তখনই তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। আচমকা হারান পরিবারের একমাত্র সম্বল প্রিয় বাবাকে। এরপর কোনো মতে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। কিন্তু অর্থের অভাবে পড়ালেখা থেমে যায় সেখানেই। পরিবারের হাল ধরতে তারপর শুরু করেন ওয়েব ডিজাইন শেখা। সেটিই তাকে নিয়ে গেল সফলতার শিখরে। একদিন অর্থের অভাবে যার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই তিনিই এখন অন্যদের অনুপ্রেরণা। কাজের জন্য একটা পুরনো কম্পিউটার কেনার সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা জমাতে যাকে দিনের পর দিন আলুভর্তা-ডাল খেয়ে থাকতে হয়েছে। সেই ছেলেটির এখন মাসেই গড়ে আয় ৯ হাজার ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ১০ লাখ)। বাঁধার সব পাহাড় ডিঙিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করে সফল হওয়া এই তরুণের নাম মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন। সফলতার পেছনের সিঁড়িগুলো কীভাবে একে একে পেরিয়েছেন এ নিয়ে কফিল বলেন, পটিয়ার কৈয়গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। বাবার আয়ে ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। কিন্তু অল্প বয়সে বাবাকে হারাতেই আমাদের পুরো পরিবার বিপদে পড়ে যায়। আল্লাহর রহমতে ভালভাবে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এডমিশন নেই। কিন্তু টাকার অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। বাস্তবতার শিকার হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে দিলেও প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল ভাল কিছু করার। ২০১৭ সালের শেষের দিকে ওয়েব ডিজাইন শেখা শুরু করেন কফিল। কম্পিউটার না থাকায় প্রথম দিকে মোবাইল দিয়েই আন্তজার্তিক বিভিন্ন ওয়েব সাইড থেকে এইচটিএমএল (ওয়েব ডিজাইনের স্ট্রাকচার) ও সিএসএস (ওয়াব ডিজাইন) শেখা শুরু করেন তিনি। এরপর বহুকষ্টে টাকা জমিয়ে কেনেন একটি কম্পিউটার।

 

কম্পিউটার কেনার সেই গল্প বলতে গিয়ে এখনো চোখ মোছেন কফিল। বলেন, কয়েক মাস অনেক কষ্টে পরিবারকে একটানা আলু, ডাল খেয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মত জমাই। সেই টাকা দিয়ে পুরাতন একটা সিপিইউ, সঙ্গে একটা এসোনিক’র চায়না মনিটর কিনি। নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সময়টা তখন কতটুকু খারাপ ছিল সেটা কোনোভাবেই বুঝানো সম্ভব না। শুধুমাত্র সাড়ে পাঁচ হাজারটা টাকার জন্য আমার পরিবারে দিনের পর দিন ডাল-ভাত খেতে হয়েছিল, যাতে মাস শেষে কিছু টাকা জমাতে পারি কম্পিউটার কেনার জন্য।

 

এ পর্যায়ে আসতে তাকে করতে হয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা। তিনি আরো বলেন, যেদিন প্রথম ফ্রিল্যান্সিংয়ে কথা শুনি এবং ভালোভাবে জানি। তখন থেকে একটাই পরিকল্পনা, এই সেক্টরেই কিছু করতে হবে। যার জন্য এখনো প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। কোনো কোচিং সেন্টার, মেন্টর, ভালো নেট সংযোগ ছাড়া, পারিবারিক হাজারো সমস্যা ও চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজে নিজে শিখেন কাজটি। মাসে মাত্র ৩ হাজার টাকা আয়ের আশায় ফাইবার মার্কেটপ্লেসে একাউন্ট খুলি পরিবারকে মাসে অন্তত ৫ দিন ডাল ভাতের বদলে আরেকটু ভালো কিছু দিতে। ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে সে ২০১৯ সালে আমেরিকান একটা কোম্পানি ‘সুপ্রিম সিস্টেমস ইনক.’ ওয়েব ডেভেলপার হিসাবে নিযুক্ত হই। ২০২০ সাল থেকে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস ‘এফলোন্ট সলউশন গ্রুপ’ কোম্পানিতে সিনিয়র ওয়ার্ডপ্রেস ডেভেলপার হিসাবে নিযুক্ত হই। ফাইবার মার্কেটপ্লেসে এক লক্ষ ইউএসডি আর্নিংয়ের মাইল ফলক অর্জন করি। এ পর্যন্ত আমি ৯৫টির বেশি দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করেছি। যদিও আমি মূলত মার্কেটপ্লেসের বাইরে ডাইরেক্ট ক্লায়েন্টস এবং কোম্পানিদের সাথে বেশি কাজ করি।

 

তবে পরিচয়ের সংকটে ভুগতে হয় এ পেশায়। আমাদের দেশের মানুষ এখনো ফিল্যান্সার কি, এটাই ভালোভাবে বুঝে না। প্রথমে এই সমস্যার সম্মুখিন আমাকেও হতে হয়েছে। আবার অজোপাড়া গাঁয়ে এটি আরো বড় সমস্যা। যদিও বিগত কয়েক বছর সরকারের ফিল্যান্সিং বিষয়ক বিভিন্ন প্রচার প্রসারের ফলে এখন অনেক মানুষ এই বিষয়ে জানছেন।

 

সমস্যা : ফ্রিল্যান্সারদের আয় সাধারণভাবে অনিশ্চিত। কোনো মাসে অনেক কাজ আসে, ভালো আয় হয়। আবার কোনো মাসে কাজের অভাব থাকে। যে কারণে বাজেট তৈরি এবং ব্যয় পরিকল্পনা করতে কঠিন হয়। এছাড়া বাংলাদেশে পেপাল সিস্টেম না থাকায় কাজের পরে পেমেন্ট আনতে বিভিন্ন জটিলতা আর সীমাবদ্ধতায় পড়তে হয়। এ কারণে মাঝে মাঝে ক্লায়েন্ট হারাতে হয়। উন্নত বিশ্বের এ ক্লায়েন্টরা শুধু এ কারণেই ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের মানুষদের দিয়ে কাজ করেন। দেশে পেপাল সিস্টাম না থাকায় কাজের অর্থ অনলাইনভিত্তিক লেনদেন সেবা পেওনিয়ার, ওয়াইজ, জুম (আন্তর্জাতিক টাকা আদানপ্রদান সংস্থা) মাধ্যমে নিজের ব্যাংকে আনতে হয়।

 

লক্ষ্য : নিজের পাশাপাশি গত দু’বছরে আমাদের ইউনিয়নের বন্ধু-বান্ধব এবং ছেলে মেয়েদের ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক গাইডলাইন দিয়ে আসছি। এরমধ্যে পাঁচ থেকে সাতজন গত ছয় মাস যাবত আমার সাথে প্রজেক্টভিত্তিক কাজ করছে। কাজ বেশি থাকলে সাত জনই কাজ করে। আর কাজ কম হলে মানুষও কমে। এদের বেতন কোনো মাসে ৫০ হাজারের উপরও পড়ে। তাদের কর্মসংস্থান হয়েছে। স্বপ্ন আছে উপজেলাভিত্তিক বিনামূল্যে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিব। উপজেলায় মেধাবী, বেকার তরুণরা ভালো গাইডলাইন পেলে তারাও স্বাবলম্বী হবে। নিজের সামান্য জ্ঞান থেকে একটি ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক প্রতিষ্ঠান খুলতে চাই।

 

সরকারের কাছে প্রত্যাশা : ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নত করা। এটি উন্নত হলে অনলাইনে কাজ করার সুযোগ বাড়ে। ব্যক্তিগত একাউন্ট ও পেমেন্ট গেটওয়ে প্রদানের সুবিধা তৈরি করা। ডিজিটাল সেভিংস এবং ব্যক্তিগত পেনশনের ব্যবস্থা করা। সরকারিভাবে স্থানীয় স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি অবশ্যই গ্রামাঞ্চলেও এ ব্যবস্থা করতে হবে। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সরকারিভাবে আইটি সেন্টার চালু করা। যেখানে ট্রেনিং দেয়া এবং যারা ইতোমধ্যে ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কাজ করছে তাদের কাজের ধরনগুলো অন্যেদের সাথে শেয়ারের মাধ্যম তৈরি করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দেশে পেপালের মাধ্যমে ট্রাঞ্জেকশনের ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। তাহলে প্রজেক্ট হারাতে হবে না।

 

নতুনদের উদ্দেশ্যে : প্রথমেই টাকার কথা চিন্তা না করে মনোযোগ দিয়ে অন্তত এক বছর কাজ শিখতে হবে। নিজের স্কিল ডেভেলপের জন্য গুগল, ইউটিউবে অনেক ভিডিও আছে সেগুলো দেখতে হবে। উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া সঠিক গাইডলাইন এবং ভালো একটি কম্পিউটার ছাড়া সফল ফ্রিল্যান্সার হওয়া কঠিন। সে কারণে এর ব্যবস্থা থাকাও জরুরি।

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট