ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অস্থায়ী ওয়ার্ড বয়। চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরে হয়ে যান বিশেষজ্ঞ ডাক্তার! দেশি-বিদেশি একাধিক ডিগ্রি লাগিয়ে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছিলেন স্নায়ু রোগের। অথচ তার বিদ্যার দৌড় ছিল মাত্র অষ্টম শ্রেণি। যদিও তার দাবি, তিনি এইচএসসি পাস। প্রায় দেড় যুগ ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পেশাগত নানা ডিগ্রির এত ভার নিয়ে নির্বিঘ্নে চিকিৎসা সেবা দানকারী এই ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ খোরশেদ আলম। অবশেষে স্বাস্থ্য প্রশাসনের হাতে ধরা পড়েন তিনি।
বিস্ময়কর হচ্ছে- এক কিংবা দুই বার নয়, অন্তত ছয়বার আটক হয়েছেন তিনি। এমরধ্যে তিনবার সাজাও খেটেছেন। এরপরও একই পেশায় ঘুরে ফিরে ভুয়া চিকিৎসক খোরশেদ। শুধু ডাক্তারি নিয়েই নয়, নাম ঠিক থাকলেও ঠিকানা ব্যবহার করেছেন একাধিক স্থানের। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আবারও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন কথিত এ চিকিৎসক। তবে এতবার সাজার পরও কী মধু ডাক্তারিতে? এমন প্রশ্নই ঘুরছে স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের মনে। যদিও ভ্রাম্যমাণ আদালত পেশাদার এ প্রতারককে দুই মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য প্রশাসন। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সাল থেকেই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় প্রথম ধরা পড়েন ভুয়া এ ডাক্তার। এরপর সাতকানিয়া ছেড়ে দিয়ে পাড়ি দেন হাটহাজারী উপজেলায়। সেখানেও খুলে বসেন চেম্বার। ২০১১ সালে হাটহাজারীতে ধরা পড়ার সময়ে তাকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হয় বলে দাবি করেন স্বাস্থ্য প্রশাসন। তবে ২০১৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালানোর সময় ধরা পড়েন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক পরিচয় দেয়া কথিত ডাক্তার মুহাম্মদ খোরশেদ আলম। এসময় ভ্রাম্যমাণ আদালত ভুয়া চিকিৎসক খোরশেদকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পরে জামিনে বের হয়ে খোরশেদ কিছুদিন আড়ালে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি মাগুরায় গিয়ে ফের একই পেশা শুরু করেন। তবে ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল মাগুরার গ্রামীন ল্যাব মেডিকেল সার্ভিসেস নামে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুয়া ডাক্তার খোরশেদের খবর পেয়ে তাকে আটক করে প্রশাসন। ওই সময়ে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখান থেকে কারাভোগের পর পাড়ি জমান চট্টগ্রাম শহরে। চেম্বার খুলে বসেন নগরীর জামালখান ও কাট্টলী-পাহাড়তলী এলাকায়। কিন্তু ২০২১ সালের ৬ জুলাই নগরীর আকবর শাহ থানাধীন কর্নেল জোন্স সড়কের হাজী ইব্রাহিম ম্যানশনে কাট্টলী মেডিকেল হল থেকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি ও ছদ্মবেশ ধারণের অপরাধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়। বেশ কিছুদিন কারাভোগের পর গা ঢাকা দেন খোরশেদ। এরপর ফের একই পেশায় ফিরে আসেন তিনি। শুরু করেন ডাক্তারি নামে প্রতারণা।
এদিকে, খোরশেদ আলম কখনো হাটহাজারী, আবার কখনো চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার হওয়ার সময় ঠিকানা দেন তিনি কক্সবাজারের রামু উপজেলার বাসিন্দা বলে। তবে তার এমন প্রতারণার বিষয় জেনে চমকে ওঠেন খোদ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য পরিচালক।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মো. মহিউদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই মাসের সাজা দিয়েছেন। তবে পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি- কুমিল্লা, মাগুরায় ও চট্টগ্রামেও গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছিলেন। বারবার সাজা খাটার পরও শোধরাননি। তার বিরুদ্ধে আরও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কিনা, সে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করা হবে। অবশ্যই তার শাস্তি পাওয়া উচিত।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধ অনুযায়ী সাজা কম হওয়ার কারণে বারবার একই কাজে লিপ্ত হচ্ছেন ভুয়া এ চিকিৎসক। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি কম থাকায় নামিদামী কিংবা নিজস্ব চেম্বার খুলে দিনের পর দিন প্রতারণা করে যাচ্ছেন তারা। যার কারণে সাধারণ রোগীদের অঙ্গহানি থেকে শুরু করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তাই এসব কথিত ডাক্তারের লাগাম টানতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরও বেশি কঠোর হওয়ার পরামর্শ সচেতন নাগরকিদের।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘চিকিৎসার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বারবার অপরাধ করার পরও একই কাজে লিপ্ত থাকার বিষয়টি উদ্বেগের। এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে অপরাধ অনুযায়ী সাজা তার কাছে কিছুই না। যার কারণে বারবার একই কাজে জড়াচ্ছেন। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার লোককে আরও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে যেসকল ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ল্যাব এসব ভুয়া চিকিৎসককে চেম্বার খুলে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) নগরীর চকবাজার এলাকার একটি বাসায় চিকিৎসা দিতে গিয়ে ধরা পড়েন ভুয়া চিকিৎসক মুহাম্মদ খোরশেদ আলম (৪৫)। তিনি নিজেকে এমবিবিএস (ঢামেক), এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (নিউরোলজি) ও ফেলো ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি দাবি করতেন। চেম্বারে রোগী দেখার ভিজিট নিতেন ২ হাজার টাকা। পরে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ২ মাসের কারাদ- একইসঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
পূর্বকোণ/আরডি