সিট খালি থাকে না কখনো চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার হাসাপাতালে। টাকা দিলেই মিলে হাসপাতালের সিট। কারা হাসপাতালের দুই রাইটার এবং দুই কারারক্ষী কারা হাসপাতাল চিকিৎসকের পক্ষে টাকার বিনিময়ে সুস্থ বন্দীদের হাসপাতালের সিটে আয়েসে থাকার সুযোগ করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুই কারারক্ষী মূলত কারা হাসপাতালের চিকিৎসকের পক্ষে টাকার লেনদেন করেন। দুই বন্দী কারা হাসপাতালে রাইটারের দায়িত্ব পালনের আড়ালে মূলত বন্দীদের সিটে থাকার দরদাম করে দুই কারারক্ষীর সাথে যোগাযোগ করে দেন। চট্টগ্রাম কারাগার হাসপাতাল ঘিরে মাসে অন্তত ১৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়। ইফতেখার ও মুশফিক নামে দুই বন্দী এবং রিয়াজুল ও সরোয়ার নামে দুই কারারক্ষীকে চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিলেই মিলে কারা হাসপাতালের সিট।
গত সোমবার কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসা অন্তত পাঁচজন বন্দীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। তারা জানান, হাসাপাতালে সিট পেতে প্রথম মাস গুনতে হবে ১৬ হাজার ৫’শ টাকা। পরবর্তী মাস থেকে গুনতে হয় ছয় হাজার টাকা করে। চাইলে মাসে ছয় হাজার টাকা দিয়ে মাসের পর মাস কারা হাসপাতালে আয়েশে থাকা যায়। টানা তিনমাস থাকলে নতুন করে ফের ১৫ হাজার টাকা ভর্তি ফি দিতে হবে। এভাবেই চলছে কারা হাসপাতালের সিট বাণিজ্য। অনেক সময় দেখা যায় কোন বন্দী ১৬/১৭ হাজার টাকা দিয়ে এক মাসের জন্য হাসপাতালে সিট নেয়ার দুই একদিনের মধ্যে জামিনে বের হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে নতুন করে কেউ ভর্তি হলে তাকেও ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কোন বন্দীর কারা হাসপাতালে থাকতে হলে প্রথমে হাসপাতালের চিফ রাইটার ইফতেখার ও ২৩ নং ওয়ার্ডের রাইটার হাজতি বন্দী মুশফিকের সাথে যোগাযোগ করেন। টাকা লেনদেনের ব্যাপারে কথাবার্তা পাকা হলে কারারক্ষী রিয়াজুল ও সরোয়ার কারাগারের বাইরে গিয়ে বন্দীর স্বজনের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন। আর টাকা নিয়ে যাবার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কারারক্ষীরা প্রতি হাজারে ১০০ টাকা কমিশন নেন, কেটে রাখে। কারা অভ্যন্তরে নানা অনিয়ম চললেও তা খুব একটা বাইরে জানাজানি হয় না। আদালতে হাজিরা দিতে আসা কিংবা কোন বন্দী জামিনে বের হলে এসব বিষয় জানা যায়। কারা কর্তৃপক্ষ অনিয়মের বিষয় কখনো স্বীকার করে না। কারা হাসাপাতালের ২৩ নং কক্ষে রাইটারের দায়িত্ব পালন করছে হাজতি আসামি মুশফিক। নিয়ম অনুযায়ী সশ্রম কারাদ-প্রাপ্ত আসামি কারা অভ্যন্তরে বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। সাজাপ্রাপ্ত না হয়ে মুশফিককে কারা হাসপাতালে রাইটারের দায়িত্ব দেয়া প্রসঙ্গে কারা চিকিৎসক শামীম রেজা জানান, রাইটার কারা কর্তৃপক্ষ দেয়। কিন্তু হাজতি বন্দী মুশফিকের পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত আসামি প্রায় ৪’শ। সাত হাজার বন্দীর জন্য ৪’শ সাজাপ্রাপ্ত খুবই নগন্য। তাছাড়া হাসপতালে রাইটারের কাজ করতে গেলে শিক্ষিত লোক লাগে। কারা হাসপাতালে ওয়ার্ড আছে ১৬টি। ১৬ ওয়ার্ডে ১৬ জন রাইটার লাগে। এরমধ্যে সাজাপ্রাপ্ত রাইটার আছে মাত্র ৪ জন। আমার তো কাজ চালাতে হবে।
কারারক্ষী রিয়াজুল আর সরোয়ার বন্দীদের টাকা দিয়ে কারা হাসপাতালে সিট পাইয়ে দেয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি সত্য নয়। হাসপাতালে বেড ফাঁকা আছে। ১০০ বেডের হাসপাতালে রোগীভর্তি আছে ৬৮ জন। আরো ৩২টি বেড ফাঁকা। জেলখানায় বন্দীর সংখ্যা আগের চেয়ে কম। বন্দী কমলে রোগীর সংখ্যাও কমে যায়। হাসপাতালে কিংবা কেস টেবিলে রাইটার হওয়া একটি সম্মানের কাজ। কেউ একজন রাইটার হিসাবে আসতে চাইলে, অনেকে সুপারিশ করে। আমি তো নিজে রাইটার নিই না। কারো জন্য সুপারিশও করি না। কেউ সুবিধা না পেলে মনক্ষুণ্ন হয়। আসলে জেল খানায় খারাপ লোক নিয়ে বসবাস করা লাগে। যারা কারাগারে আসে তারা কোন না কোন খারাপ কাজ করে আসে। অনেকে পরিস্থিতির শিকার হয়ে আসে। তবে সেই সংখ্যা খুবই কম। যখনি কেউ অবৈধ সুযোগ সুবিধা পায় না তখন অভিযোগ করে। দেখা গেলো যে কেউ রাইটার হিসাবে আসতে চায়, কিন্তু আসতে পারলো না,তখনি বিভিন্ন অভিযোগ করে।
রিয়াজুল কিংবা সরোয়ার টাকার বিনিময়ে বন্দীদের হাসপাতালে সিটের ব্যবস্থা করে দেন- বিষয়টি সত্য নয়, কারা চিকিৎসক শামীম রেজা এমনটি দাবি করেন। তবে একজন বন্দীকে হাসপাতালে রাখা যাবে কিনা জানতে চেয়ে এ প্রতিবেদক মুঠোফোনে কারারক্ষী রিয়জুলের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ‘আপনি আমার নম্বর কোথায় পেলেন’। বললাম, কারাগার থেকে বের হওয়া একজন বন্দীর কাছ থেকে নিয়েছি, যিনি আপনাকে টাকা দিয়ে কারা হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালে একজন বন্দী রাখব কত টাকা লাগবে জানতে চাইল তিনি বলেন, বন্দী এখন কোন ওয়ার্ডে আছে? আপনি সকাল নয়টার আগে এসে সরাসরি দেখা করেন। নয়টার পর আমি জেলখানার ভেতরে ঢুকে যাব, তখন পাবেন না। হাসপাতালে থাকতে হলে, কতটাকা লাগতে পারে জানতে চাইলে রিয়াজুল বলেন, যিনি আপনাকে আমার নম্বর দিয়েছেন হাসপাতালের সিটে থাকতে কথা টাকা লাগবে তিনি নিশ্চয় বলেছেন। সাক্ষাতে দেখা হলে বিস্তারিত জানাবেন এ কথা বলে ফোনের লাইন কেটে দেন রিয়াজুল।
চট্টগ্রাম কারাগারের সাধারণ ওয়ার্ডে খাবার, পানিসহ নানা সংকট থাকলেও হাসপাতালে এসব সমস্যা নেই। অসুস্থ কারাবন্দীদের সুবিধার্থে সাধারণ ওয়ার্ডে থাকা বন্দীদের চেয়ে কারাবিধি অনুযায়ী হাসপাতালে সুযোগ সুবিধা বেশি রাখা হয়েছে। যার কারণে আর্থিকভাবে সচ্ছল বন্দীরা টাকার বিনিময়ে ‘রোগী সেজে’ হাসপাতালে আরাম-আয়েশে বন্দী জীবন কাটায়। বন্দীদের সাধারণ ওয়ার্ডে সকাল ছয়টা থেকে আটটা এবং বিকেল তিনটায় দুই বেলা পানি সরবরাহ করা হয়। মাঝে মাঝে তাও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কারা হাসপাতালে সকাল ছয়টা, দুপুর একটা এবং বিকেল তিনটায় তিন বেলা পানি সরবরাহ করা হয়।
পূর্বকোণ/আরডি