
শিল্প এলাকা হিসেবে দেশব্যাপীখ্যাত আনোয়ারা উপজেলা, এখানে রয়েছে পর্যটনকে সমৃদ্ধ করার ব্যাপক সম্ভাবনা। সাগর, পাহাড়, নদী সব কিছুরই সমন্বয় ঘটেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এই উপজেলাটিতে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা হিসেবে যেমন সমুদ্রের লোনা পানির স্বাদ নেওয়া যায়, উপভোগ করা যায় ঢেউয়ের অপরূপ সৌন্দর্য, তেমনি রয়েছে গহীন দেয়াঙ পাহাড়ের হাজার বছরের ইতিহাস। এছাড়া রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের জমিদার বাড়ি।
পারকি সমুদ্র সৈকত:
সন্ধ্যায় রক্তিম সূর্য দেখতে কার না ভালো লাগে। যদি তা হয় ঝাউগাছের শিকড়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে, হাতে রং চায়ের চুমুকে। তাহলে এমন একটি মুহূর্তের জন্য চলে আসতে পারেন সাগর কন্যা নামেখ্যাত দ্বিতীয় বৃহৎ পারকি সমুদ্র সৈকতে। বারাশত ইউনিয়ন পরিষদ ২০১৩ সাল থেকে সৈকতকে পর্যটন স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলায় অবস্থিত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত এটি। পারকি সমুদ্র সৈকতে রয়েছে ঘোড়া, রাইডিং বোট, বসার জন্য বড় ছাতাসহ হেলানো চেয়ার, মজার খেলা রিং থ্রো, ইচ্ছে করলে হাতের নিশানা পরখ করে দেখতে পারেন। এছাড়াও রয়েছে লুসাই পার্ক, মোহনা পার্ক নামের সুবিশাল নান্দনিক পিকনিক স্পট।
গহিরা প্যারাবন:
শঙ্খ নদী ও বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এক নীরব প্রকৃতির মেলা। ঘন প্যারাবন আর সারি সারি ঝাউগাছ আর চোখ ধাঁধানো মনোরম দৃশ্য আপনার মনমেজাজ ফুরফুরে করার জন্য যথেষ্ট। তাই বর্তমানে আনন্দ ভ্রমণ কিংবা পিকনিক স্পটের বিকল্প হিসেবেও পর্যটকরা বেছে নিয়েছেন এ অঘোষিত প্রাকৃতিক দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্থানকে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলার গহিরা ১২ আউলিয়া এলাকায় এটির অবস্থান।
দেয়াঙ পাহাড়:
কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বর্তমান আনোয়ারা-কর্ণফুলীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত ঐতিহাসিক দেয়াঙ পাহাড়। ১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকরা চট্টগ্রামে আসেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজ বণিকদের দেয়াঙ পাহাড়ে কুঠি ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। আরাকান রাজাদের রাজধানী ছিল দেয়াও। এখানে রয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক বড় উঠান মিয়া বাড়ি। বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ এর পুত্র উমেদ খানের সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যামরায়। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেওয়ান মনোহর আলী খান নাম নেন, যিনি এই মিয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। রয়েছে দেয়াঙয়ের রানি মা মারিয়া। ১৬০০ সালে নির্মিত দেয়াঙ গ্রামের রাস্তার দক্ষিণ দিকে মরিয়ম আশ্রম আর মা মারিয়ার গ্রোটো। এখানেই চট্টগ্রামে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘মা মারিয়া তীর্থ উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। দেয়াঙ পাহাড়ে প্রথম বসতি স্থাপন করে ছিলো বাংলাদেশে আগত প্রথম খ্রিস্টান পরিবার। আর সেখান থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা ছড়িয়ে পড়েন। রয়েছে অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত ‘পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়’ উপমহাদেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। যা বর্তমানে বিলুপ্ত।
হিলটপ পার্ক:
দেয়াঙ পাহাড়ের ইতিহাস সংরক্ষণে পাহাড়ের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করতে বটতলী এলাকায় মোহছেন আউলিয়া কলেজের পাশে পাহাড়ের গা ঘেষে গড়ে তোলা হয়েছিল- হিলটপ পার্ক। নান্দনিকতা ও আধুনিকতাকে সমন্বিত করে পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করার এই স্বপ্ন বোনা হয়েছিলো। পাহাড়ের গায়ে শৈল্পিক নৈপুণ্যে সুবিশাল রাস্তা, কারুকার্য করা সিঁড়ি, হোটেল, ফুলের বাগান, নানান পশুর মূর্তি, সুইমিং পুল, রেস্তোরাঁসহ, আকাশি, মেহগনি ও নানা জাতের গাছ রোপণ করে বেশ সাজানো হয়েছিল পার্কটিকে। আগ্রহীরা পর্যটকদের জন্য প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাতে, চেয়েছিলেন গ্রামের সৌন্দর্য আর বঙ্গোপসাগরে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দিতে সবাইকে। বড় বড় জাহাজের গর্জন শোনার পাশাপাশি সেগুলো যাতে দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায় এমন ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন তারা পার্কটিতে। কিন্তু এসব স্বপ্ন যেন আজ স্বপ্নই রয়ে গেল। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই সরকারি নিষেধাজ্ঞায় কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। নিষেধাজ্ঞায় অপূর্ণ হিলটপ পার্কটি এখন ভৌতিক পার্ক হিসেবে পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এছাড়াও রয়েছে হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)র মাজার, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, চাঁদ সওদাগরের দিঘি, হযরত আলী রজা প্রকাশ কানু শাহ (রহ.) মাজার, বাংলাশেশ মেরিন একাডেমি, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল), ডিএপিএফসিএল, কোরিয়ান ইপিজেড, কোস্টগার্ড অফিস, বিমান বাহিনীর রাডার স্টেশন, বাতিঘর, রায়পুর, আকবরি মসজিদ, ছুরুত বিবির মসজিদ, প্রসন্ন কুমার জমিদার বাড়ি, মনু মিয়ার মসজিদ, মনু মিয়ার দিঘি, যোগেশ চন্দ্র রায়ের জমিদার বাড়ি, মেন্না গার্ডেন, স্বপ্ন কুটির, গহিরা সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, সাঙ্গু নদীর মোহনা, রাবার ড্যাম, বরুমচড়া, বন্দর বধ্যভূমি কমপ্লেক্স, আখতারুজ্জামান চৌধুরী স্মৃতি পার্ক, মিয়া হাজি দৌলত (রহ.) মাজার, সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভ্রমণ, ধলা বিবির মসজিদ, ওয়ান্ডার গার্ডেন, দোভাষীর হাট টিএন্ডটি ভবন, তৈলারদ্বীপ ব্রিজসহ বিভিন্ন মন জুড়ানো অনন্য সুন্দর স্থান।
আনোয়ারায় এত পর্যটন কেন্দ্র থাকলেও সরকারিভাবে এসব পর্যটনকেন্দ্রগুলো দেখভাল এবং উন্নয়নের জন্য তেমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পারকিতে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ চলমান থাকলেও অতিরিক্ত মেয়াদেও শেষ হয়নি প্রায় ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এই পর্যটন কমপ্লেক্সের কাজ। এর উপর রয়েছে পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগও। এছাড়া এসব পর্যটন কেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপত্তা এবং লাইটিং এর ব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার পর অবস্থান করা যায় না। যার ফলে পর্যটকদের সন্ধ্যার আগেই এসব পর্যটন কেন্দ্র থেকে বের হতে হয়।
মেন্না চৌধুরী নামে উপজেলার এক প্রকৃতিপ্রেমী জানান, আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছি। এসব ভ্রমণের মধ্যদিয়ে একটা বিষয় বুঝেছি মন ভালো করতে ঘুরাঘুরি এবং বিনোদন কেন্দ্রের বিকল্প নেই। তাই আমি ওয়ান্ডার গার্ডেন, হিলটপ পার্ক এবং সর্বশেষ মেন্না গার্ডেন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলেছি। ইচ্ছে ছিলো আনোয়ারায় নান্দনিক আরও কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করার। শরীর এখন অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে তা আর সম্ভব হচ্ছে না।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, আনোয়ারা হচ্ছে পর্যটনের সম্ভাবনাময় একটা উপজেলা। এখানে পাহাড়, সমুদ্র থেকে শুরু করে সব কিছু রয়েছে। পারকিতে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্সের কাজও চলমান রয়েছে। সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় আনোয়ারা পর্যটন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
পূর্বকোণ/ইব