চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫

সর্বশেষ:

যুক্তরাষ্ট্র ও ধনী দেশের নিষেধাজ্ঞা: বিশ্ব দারিদ্র্য ও ক্ষুধার অদৃশ্য চালক
ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্র ও ধনী দেশের নিষেধাজ্ঞা: বিশ্ব দারিদ্র্য ও ক্ষুধার অদৃশ্য চালক

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী

২৭ জুন, ২০২৫ | ১:২২ অপরাহ্ণ

আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় যেখানে একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে, সেখানে ‘নিষেধাজ্ঞা’ (Sanctions) নামক এক অর্থনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করছে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র এবং ধনী পশ্চিমা দেশগুলো- যাদের বলা হয় গ্লোবাল নর্থ (Global North) বিভিন্ন দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় আন্তর্জাতিক আইন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে।

 

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব নিষেধাজ্ঞার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়ে দাঁড়ায় এই তথাকথিত ‘শান্তিপূর্ণ’ চাপের চরম পরিণতি।

 

১. নিষেধাজ্ঞা কী এবং কে দেয়?

নিষেধাজ্ঞা মানে হলো- কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য, ব্যাংকিং, সম্পদ স্থানান্তর বা পণ্য আদান-প্রদানে বাধা সৃষ্টি করা। বিংশ শতাব্দীতে আলবেনিয়া আক্রমণের কারণে ১৯২১ সালে যুগোশ্লাভিয়ার ওপর লীগ অব নেশনস থেকে প্রথম আধুনিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র একাই বিশ্বের ৪২% সক্রিয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। এরপর রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এবং যুক্তরাজ্য। অন্যদিকে, সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার শিকার রাষ্ট্র হলো রাশিয়া। ২০২২ সালের পর থেকে এই দেশের ওপর ১৫ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশ সংখ্যা আনুমানিক ২৫-৩০টি এবং হাজারের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।

 

যেসব দেশ লক্ষ্যবস্তু:

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সিরিয়া, আফ্রিকায় জিম্বাবুয়ে ও সুদান, এশিয়ায় উত্তর কোরিয়া, লাতিন আমেরিকায় ভেনেজুয়েলা ও কিউবা এবং সাম্প্রতিককালে রাশিয়া।

 

২. নিষেধাজ্ঞা কীভাবে দারিদ্র্য ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে?

ভেনেজুয়েলা:

জাতিসংঘ (UN OCHA, 2023) অনুযায়ী ৭০ লাখ মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সেন্টার ফর ইকোনমিক এন্ড পলিসি রিসার্চ (CEPR) অনুসারে ২০১৭-২০১৮ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ৪০ হাজারের বেশি অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ছিল ১ কোটি শতাংশের বেশি, ফলে ৯০% মানুষ দারিদ্র্যের নিচে নেমে যায়।

 

ইরান:

যুক্তরাষ্ট্র যখন ২০১৮ সালে পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) থেকে বেরিয়ে আসে এবং নতুন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন দেশটির জিডিপি (GDP) বছরে ৬-১০% হারে হ্রাস পেতে থাকে এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ৬০% ছাড়িয়ে যায়। ২০২২ সালে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় (Iranian Parliamentary Research Center)।

 

সিরিয়া:

গৃহযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা। ধ্বংস হলো ৯০% অর্থনীতি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (WFP) বলছে- ১২.১ মিলিয়ন মানুষ, অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা, এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

 

৩. কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় সরাসরি প্রভাব:

নিষেধাজ্ঞা দেশের কৃষিযন্ত্রপাতি, সার ও বীজ এবং আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে পুরো খাদ্যব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জাতিসংঘের ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী- ২০২২ সালে ৭৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধায় ভুগেছে। এর প্রধান কারণ হলো সংঘাত এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।

 

জাতিসংঘের খাদ্য অধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ২০২০ সালে বলেছিলেন- নিষেধাজ্ঞা এক ধরনের গণশাস্তি, যা মানুষের খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং জীবনের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়।

 

৪. উন্নয়ন অর্থায়নে বাধা:

নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে দেশগুলো আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক অর্থায়ন পায় না। যেমন- আফগানিস্তান। তালেবান আসার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের ব্যাংকে থাকা ৭ বিলিয়ন ডলার জব্দ করে। ফলে এখন ৯৭% আফগান দারিদ্র্যসীমার নিচে (UNDP, ২০২৩)। এছাড়া দেশটির স্কুল, হাসপাতাল, অবকাঠামোসব উন্নয়নই স্থবির হয়ে পড়েছে।

 

৫. ব্যর্থতার পথে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs):
২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের লক্ষ্য ছিল- দারিদ্র্য দূরীকরণ (SDG 1), ক্ষুধা নির্মূল (SDG 2) এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন (SDG 3)। কিন্তু ২০২৪ সালের SDG রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩০ সালেও ৬০০ মিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্রে থাকবে। মাত্র ১৫% লক্ষ্য পূরণের পথে রয়েছে এবং নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলো পুরো উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছে।

 

৬. আর্থিক উপনিবেশবাদ ও বৈষম্য:

নিষেধাজ্ঞা আসলে এক ধরনের আর্থিক উপনিবেশ। যা ধনী দেশগুলো SWIFT, IMF, World Bank ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। এতে মার্কিন ডলারকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে দরিদ্র দেশগুলো নির্ভরশীল থাকে, স্বাধীন হতে পারে না। ক্রেডিট সুইস গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট অনুযায়ী- ২০২৪ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০% মানুষ দখলে রেখেছে মোট সম্পদের ৭৬ শতাংশ, আর নিম্ন ৫০% মানুষের ভাগ মাত্র ২%। অর্থাৎ, নিষেধাজ্ঞা একপ্রকার অর্থনৈতিক যুদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা যতটা ‘অশান্তিহীন কূটনীতি’, তার প্রভাব ততটাই ধ্বংসাত্মক। বিশেষ করে সাধারণ নাগরিকদের ওপর।

 

মূল বার্তা:
নিষেধাজ্ঞা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সংকট ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা বাড়ায়। এটি নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলো উন্নয়নযাত্রা থেকে বাদ পড়ে এবং বৈশ্বিক দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে হলে এই কাঠামোগত সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।

 

করণীয়:

বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখনই তিনটি বিষয়ে ভাবতে হবে। এগুলো হলো-
১। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে নিষেধাজ্ঞার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
২। মানবিক খাতে ব্যতিক্রম বা ছাড় নিশ্চিত করতে হবে।
৩। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে সব দেশ ন্যায্য সুযোগ পায়।

 

‘গোলাবারুদ দিয়ে যেমন গণতন্ত্র আনা যায় না, তেমনি ক্ষুধা দিয়ে কোনো জাতিকে শান্তিতে আনা যায় না।’

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট