১৩ জুন ইসরায়েল ইরান আক্রমণ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সরকার পরিবর্তন; এমন সরকার যারা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর মতো পশ্চিমের তাঁবেদারি করবে, সামরিক শক্তি বাড়ানো অপ্রয়োজনীয় মনে করবে, তলে তলে বা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, প্যালেস্টাইনিদের ঘৃণা করবে, নাইটক্লাব হবে, মেয়েরা নাচবে, মদ-জুয়া চলবে, আর ইসরায়েলকে বলবে, ‘বুকে আসো, তোমরা আমাদের ইব্রাহামিক ভাই।’ এই লক্ষ্য পূরণে তারা কয়েকটা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল।
১। ইরান যখন আক্রমণ আশা করছে না তখন আক্রমণ করা, মানে আমরা যাকে সারপ্রাইজ এটাক করা বলি। মনে রাখতে হবে, এই সময় ইরান আর আমেরিকার মধ্যে আলোচনা চলছিল। আলোচনায় ইরান অনেক নমনীয় হয়েছিল; একটা চুক্তি হয়ে যাবে এমন ধারণা করা হচ্ছিল, পরবর্তী বৈঠকের তারিখ ছিল দুদিন পর। ১৫ জুনের আগে ইসরায়েল আক্রমণ করবে ইরান ভাবেনি, তাই তাদের সতর্কতা কম ছিল।
২। প্রথম রাতেই ইরানের শীর্ষ জেনারেল এবং শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করা।
৩। প্রথম রাতেই ইরানের এয়ার ডিফেন্স ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে করে আরও কয়েকদিন ধরে বিনা বাধায় বিমান দিয়ে আক্রমণ চালানো যায়।
৪। পরবর্তী কয়েকদিন গাড়ি-বোমা, হত্যা এবং অন্যান্য নাশকতা চালানো।
এভাবে ভয় ও অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকারকে অকেজো করে দেওয়া এবং দেশের ভেতরে বা বাইরে আগে থেকে ঠিক করে রাখা কাউকে ক্ষমতায় বসানো।
ইসরায়েল কৌশলগত সফলতা লাভ করলেও মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। ইরানের সরকার টিকে যায়, এয়ার ডিফেন্সের একটা বড় অংশ ইরান আবার চালু করতে সক্ষম হয় এবং মোসাদের ভাড়া করা অধিকাংশ মানুষকে পাকড়াও করা হয়। এই সময় ইরানের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে বিভক্ত ইরান ইসরায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়েছে।
ইরান প্রতি-আক্রমণ শুরু করে। ইরান যেহেতু যুদ্ধ শুরু করেনি, তাই তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। যেমন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল-
১। হামলার বিপরীতে আত্মরক্ষার কৌশল নেওয়া; দেশ ও সরকার রক্ষা।
২। শক্তি প্রদর্শন।
৩। ইসরায়েলের এমন ক্ষতি করা যে তারা আবার আক্রমণ করতে ভয় পায়।প্রতি-আক্রমণের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ইরান সবগুলো লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়। এরপর ইরানের আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
অন্যদিকে, প্রথম ৪৮ ঘণ্টা পর ইসরায়েলের দিক থেকে যুদ্ধ থামানোর ইঙ্গিত আসতে থাকে। আমেরিকার সংবাদপত্রে এমন হিসাব দেওয়া হয় যে, ইসরায়েল আর ১০-১২ দিন মিসাইল আক্রমণ মোটামুটি ঠেকাতে পারবে।
তবে কি ইসরায়েল ইরানের শক্তিকে ছোট করে দেখেছিল? আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর দুটো। ক) ইসরায়েল ভেবেছিল সরকার পতন হবে, ইরানের মিসাইলের সম্মুখীন তাদের হতে হবে না। খ) মিসাইল আসলেও তারা তা রুখতে পারবে।
ইরান যুদ্ধ আরও কিছুদিন না চালিয়ে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলো কেন? আমার মনে হয় উত্তর দুটো। ক) আরও কয়েকদিন যুদ্ধ চালিয়ে তাদের আর পাওয়ার কিছু ছিল না; তারা ইসরায়েলের প্রচুর ক্ষতি করেছে, যা নজিরবিহীন। খ) যুদ্ধে নিজেদেরও ক্ষতি হচ্ছিল। তেমন কোন লাভ না পেয়ে ক্ষতি মেনে নেওয়া দীর্ঘস্থায়ী কোন লক্ষ্য পূরণ করবে না।
সবমিলিয়ে এই কথা বলা ভুল হবে না যে, ইরান তার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল কৌশলগত কিছু বিজয় অর্জন করলেও লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধে তাই ইরানকেই বিজয়ী বলতে হবে।
এরপর কী হবে?
দু’পক্ষই নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। ইরানের জন্য এই কাজ তেমন কঠিন নয়। তারা তাদের আসল ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, তাই বোমা বানানোর সরঞ্জাম তাদের হাতে এখনও আছে। ইরানকে অবশ্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম উন্নত করতে হবে।
ইসরায়েলের কিছু ক্ষতি অবশ্য অপূরণীয়। যেমন- তাদের একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার এবং জীবাণু গবেষণাগার পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তাদের আরও অনেক ক্ষতি হয়েছে যা এখনও জানা যায়নি। এছাড়াও তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি মনস্তাত্ত্বিক- তাদের অপরাজেয় ইমেজ ধ্বংস হয়ে গেছে, শিশু এবং মেয়েদের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করলেও আসল যুদ্ধে তারা ভয় পায়। ইসরায়েল অবশ্য চেষ্টা করে যাবে ইরানের ভেতরে হত্যাকা- এবং অন্যান্য নাশকতা চালিয়ে যাওয়ার।
এখন দেখার বিষয়, যুদ্ধবিরতি কয়দিন টেকে!
লেখক: নিউজিল্যান্ড প্রবাসী চিকিৎসক