ইয়াবা পাচার রোধে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তার সফলতা আসছে না। থেমে নেই ইয়াবা পাচার, সময়ের সাথে বাড়ছে; ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। কোনমতেই থামানো যাচ্ছে না পাচার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবিরের গবেষণায় উঠে এসেছে ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে দুর্বল দিক ও ব্যর্থতাগুলো।
ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে দুর্বল দিক: বন্দরে হাজার হাজার সিএফটি কাঠ, পেঁয়াজ, চাল, ডাল, বাঁশ, মাছসহ নানা পণ্য আসে। এতকিছু তল্লাশি করে ইয়াবা বের করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পক্ষে অসম্ভব। জনবলের অভাবে সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইয়াবার বিরুদ্ধে অভিযান সম্পূর্ণভাবে গোয়েন্দা সংবাদের উপর নির্ভরশীল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেকেই ইয়াবা বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়া বা ইয়াবা পাচারকারীদের সহায়তা করা। ট্রেনে ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে তল্লাশি না করা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বা থানা পুলিশ, কক্সবাজার রেলস্টেশনে না থাকা। সমুদ্রপথে নৌকায় ইয়াবা পাচার রোধে পর্যাপ্ত তল্লাশি না থাকা। রোহিঙ্গাদের অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরা তাদের মাদক পাচারে জড়িত করছে। ইয়াবা পাচারকারীরা দ্রুত জামিনে এসে পুনরায় ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ে। চেক পয়েন্টে জনবল এবং স্থানের স্বল্পতায় গাড়ি ও যাত্রীদের ভালোভাবে তল্লাশি করা সম্ভব হয় না।
ভালোভাবে তল্লাশি করতে গেলে যানজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, যা সহনীয় করতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে যানবাহন, যাত্রী ও মালামাল তল্লাশি করা হয়। রুটিন তল্লাশি করে যানবাহন ছেড়ে দেয়া হয়। সি বিচ বা সমুদ্রপথে চেক পয়েন্ট না থাকায় ইয়াবা পাচার হয় নির্বিঘ্নে। অনেক সময় সোর্সকে ইয়াবা পাচারকারীরা মারধর করে। দুর্ঘটনার মাধ্যমেও সোর্সকে মেরে ফেলা হয়। এতে ভয়ে অনেকে তথ্য দিতে চায় না। মাদক শনাক্তকরণ যন্ত্র বা ইয়াবা শনাক্ত করতে পারে এমন কুকুরের অভাবে ইয়াবা ধরা যায় না। মহিলা সদস্যের অভাবে অনেক সময় ইয়াবা বহনকারী মহিলাদের যথাযথভাবে তল্লাশি করা সম্ভব হয় না। প্রয়োজনীয় নৌযানের অভাবে সমুদ্র ও নদীপথে ইয়াবা ধরা সম্ভব হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ইয়াবা চোরাচালান ধরতে না পারার একটি বড় কারণ। সকল বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।
ইয়াবা পাচার রোধে ব্যর্থতার কারণ: টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইয়াবার ওয়্যারহাউস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মাদকচক্রের সাথে যোগসাজশে মাদক ব্যবসায় জড়িত হওয়া। মাদক উৎপাদন স্থানে মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবেলায় মাদককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা। কক্সবাজারে সামাজিক শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করা। টেকনাফ ও উখিয়ায় বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি মাদক অপরাধে জড়িয়ে পড়া এবং মাদক ব্যবসাকে অপরাধ হিসেবে সামাজিকভাবে বিবেচনা না করা। ভূপ্রকৃতি ব্যবস্থা (পাহাড়, সাগর, নদী, সমতল) ইয়াবা পাচারে সহায়ক হওয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাদক পাচারে জড়িত হওয়া। সোর্সকে ইয়াবা প্রদান করা। সড়ক, রেল, সাগরপথ ও বিমানপথে পাচারের সুযোগ থাকা। অল্প পারিশ্রমিকে রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা বহনে ব্যবহার করা। পাচারকারীরা প্রভাবশালীদের আশ্রয় পাওয়া। বহিরাগত মাদক ব্যবসায়ীদের স্থানীয়দের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার করা। ইয়াবা পাচারে সীমান্তবর্তী লোকজনের সম্পৃক্ততা থাকার কারণে মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে স্থানীয় জনগণের অসহযোগিতা। ইয়াবা পাচারের প্রধান রুটগুলোতে একাধিক স্থানে নিয়মিত তল্লাশি না থাকা। চাহিদার চেয়ে বেশি ইয়াবার যোগান থাকা।
সুপারিশ: মানি লন্ডারিং আইন প্রয়োগ করে মাদক পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ব্যাংক একাউন্ট তল্লাশি করতে হবে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের এক/একাধিক সিম ব্যবহার বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে একবার গডফাদার/পাইকারি মাদক পাচারকারীদের বাড়ি গিয়ে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তল্লাশি বৃদ্ধি করতে হবে। রোহিঙ্গা মাদক পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করতে হবে এবং তাদের ভাসানচর বা অন্য কোন স্থানে স্থানান্তর করতে হবে। মাদক পাচারকারীদের সরকারি সেবা বাতিল করতে হবে। মাদক পাচারকারীর মোবাইল সিম ও মোবাইল সেট ব্যবহার সম্পর্কে পূর্বেই ঘোষণা দিতে হবে এবং তাদের যোগাযোগ ও গতিবিধি সীমাবদ্ধ করতে হবে। প্রতিমাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজারে মাদক পরিস্থিতির অগ্রগতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এতে সকল সংস্থার ইয়াবা উদ্ধার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ইয়াবা সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতর তাদের নিয়ে ‘রোহিঙ্গা মাদক প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করতে হবে।
দারিদ্র্যতার কারণে রোহিঙ্গা নারীরা মাদক পাচারকারীদের হাতে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তা কীভাবে সঠিকভাবে রোধ করা যায় সেটা বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইয়াবা পাচার অপরাধ, এটি ব্যবসা নয়, এটি টেকনাফ ও উখিয়ার নাগরিকদের বোঝাতে হবে। তারা এটিকে ব্যবসা মনে করে। সোর্সমানি বৃদ্ধি করতে হবে এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতভাবে করতে হবে। টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় সৎ, পরীক্ষিত আইন প্রয়োগকারী জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়া রোধে আলাদা গোয়েন্দা কার্যক্রম চালু করতে হবে। জলপথে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জলযানের ব্যবস্থা করতে হবে। চেক পয়েন্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাদক শনাক্তকরণ যন্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরের ব্যবস্থা করতে হবে। তল্লাশি দলে প্রয়োজনীয় মহিলা সদস্য নিয়োগ রাখতে হবে। বাস/ট্রাক লোডিং স্থলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখযোগ্য ইয়াবা উদ্ধার ও গডফাদার ধরার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। ইয়াবা সংক্রান্ত মামলা হলে আসামিরা যেন সহজে জামিন না পায় এবং জামিনে বের হয়ে পালাতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বন্দরের উল্লেখযোগ্য স্থান সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে। রেলওয়ে ও বিমানবন্দরে সার্বক্ষণিক পাচার রোধে নজরদারি বৃদ্ধি করা। প্রয়োজনে স্থায়ী অফিস স্থাপন করা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহিতা ও নজরদারির আওতায় আনতে হবে। সকল বাহিনীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
অবৈধ বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম যাওয়া বন্ধ করতে হবে। নাফ নদীর পাড় ধরে তৈরি বেড়িবাঁধের উপর রাস্তা নির্মাণ করে উল্লেখযোগ্য স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে আকস্মিক অস্থায়ী চেকপোস্ট ও অভিযান স্থাপনের মাধ্যমে তল্লাশি বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি মাদকবিরোধী জনসচেতনতা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে।
পূর্বকোণ/ইবনুর