চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহের জট খুলেনি তিন দশকেও। এ নিয়ে সিডিএ-ওয়াসা একাধিক চিঠি চালাচালি হওয়ার পরও হয়নি কোন সুরাহা। তাতে ঝুলে আছে ৫১৯ প্লট মালিকের ভাগ্য। পানির অভাবে প্লট মালিকরা ভবন নির্মাণে উৎসাহ পাচ্ছেন না। তবে গত কয়েক মাসে দুই সংস্থার উদ্যোগী ভূমিকায় প্রায় তিন দশক পর সেখানে সম্ভাবনার উঁকি দিতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ভাণ্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী আবাসিকে পানি নিয়ে যেতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে সিডিএ। ভাণ্ডালজুড়ি থেকে কর্ণফুলী আবাসিকে নিয়ে যেতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতে পারে তার একটি ধারণাও সিডিএ’কে দিয়েছে ওয়াসা। তবে এ ব্যয় আরো কমাতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ’কে অনুরোধ জানিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম। এ নিয়ে সিডিএ’র বোর্ড সভার সাথে ওয়াসার এমডি’র আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে আজ।
১৯৯৪ সালে কর্ণফুলী নদীর বামতীরে একটি আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। তিন দশকের বেশি সময় আগে বাস্তবায়ন করা সিডিএ’র এই আবাসিকে এখনো পর্যন্ত নির্মিত হয়নি একটি ভবনও। ইতোমধ্যে আবাসিকটি পরিণত হয়েছে বন-জঙ্গলে। যে কারো দিনদুপুরেও সেখানে যেতে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। আবাসিকের ভিতরে নেই কোন সড়ক বাতি। সড়কগুলো ভেঙে ইট উঠে গেছে। সাধারণ মানুষের খুব একটা চলাচল নেই। তাই স্থানীয়দের কাছে এটি এখন জঙ্গলময় এলাকা হিসেবে পরিচিত।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুধুমাত্র পানির অভাবে ভবন মালিকরা এখানে ভবন নির্মাণ করতে আগ্রহী হননি। পানির সংকট কেটে গেলে বিদ্যুৎসহ অন্য সমস্যাও কেটে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ১৯৯১ সালের আদম শুমারির তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামের লোকসংখ্যা ছিল ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ১২৭ জন এবং সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারির তথ্যমতে চট্টগ্রামে লোকসংখ্যা হচ্ছে ৯১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৫ জন। গত ৩১ বছরে চট্টগ্রামের লোকসংখ্যা বেড়েছে ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩৮ জন। এই সময়ের মধ্যে যদি এই আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেত সেখানে অসংখ্য লোকের বাসস্থানের সুযোগ হতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়দের মতে, সিডিএ’র কর্ণফুলী আবাসিকটি বাস্তবায়িত হলে কর্ণফুলী, পটিয়া, আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দাদের মধ্যে বড় একটি অংশকে শহরমুখী হতে হবে না। বর্তমানে মইজ্জ্যারটেক এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো। নগরীর চাপ কমানোর জন্য কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্প গ্রহণ সিডিএ’র দারুণ উদ্যোগ ছিল। তবে পানির সংযোগের পাশাপাশি বিদ্যুৎসহ আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
কর্ণফুলী আবাসিক প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির একাধিক প্লট মালিক জানান, প্রায় তিন দশক আগে সিডিএ কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও পানি, গ্যাসসহ কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেনি সিডিএ। এতসব সংকটের ফলে সেখানে কেউ ভবন নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়নি।
সিডিএ কর্ণফুলী আবাসিক মালিক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সংযোগ দিলে সিডিএ-ওয়াসা উভয়ই লাভবান হবে। সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে। হাজার হাজার মানুষের বসতি গড়ে ওঠলে মহানগরীর আবাসনের চাপ কমবে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য কোথাও পাহাড় কাটছে, কোথাও পুকুর ভরাট করছে। কিন্তু কর্ণফুলীর বামতীরের ৫১ দশমিক ৬৭ একরের বেশি জায়গা নিয়ে এই প্রকল্পকে সিডিএ এখনো বাসযোগ্য করতে পারেনি। দ্রুত সময়ে এ আবাসিকে পানি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হলে এটি একটি পরিকল্পিত আবাসিক হবে।
প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম, চেয়ারম্যান, সিডিএ
সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যাপারে ওয়াসার সাথে কথা হয়েছে। ওয়াসা আবাসিকে পানি দেয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। তবে তারা আমাদের কাছে এটার খরচ বাবদ প্রায় ১০ কোটি টাকা দাবি করেছে।
ওয়াসাকে বলেছি, খরচটা আরো কমিয়ে আমাদের দিতে। যেহেতু এই টাকা আমাদের পরিশোধ করতে হবে। এ নিয়ে মঙ্গরবার (২১ জানুয়ারি) সিডিএ’র বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে আমরা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে এই বিষয়ে আলাপ করবো। দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে কর্ণফুলী আবাসিকের প্লট মালিকরা পানি পায়, আমরা সে ব্যবস্থা করছি।
মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা এমডি (ভারপ্রাপ্ত) চট্টগ্রাম ওয়াসা
গত ৩ ডিসেম্বর সিডিএ’র চেয়ারম্যান বরাবরে একটি চিঠি দেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। ওই সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, চট্টগ্রাম ওয়াসার ভাণ্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পের উৎপাদিত পানি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া, কর্ণফুলী ও আনোয়ারা এলাকার বিভিন্ন জনবসতি ও সরকারি, বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হবে।
উক্ত পানি শোধনাগার হতে বিভিন্ন এলাকার সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, এলজিইডি ও পৌরসভার আওতাধীন রাস্তাসমূহে ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন স্থাপন কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। তবে, সরকারি, বেসরকারি আবাসিক এলাকা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব রাস্তায় পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে না। এ ধরনের এলাকায় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়নে পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে।
বিগত ২০০৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম ওয়াসার ২৩১তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত মতে- ‘সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশনের নিকট থেকে প্রকৃত ব্যয়ের ১০০ শতাংশ জমা নেওয়ার বিপরীতে পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। উল্লেখ্য, সিডিএ কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহের স্বার্থে ইতোমধ্যে সন্নিকটস্থ স্থানে ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন স্থাপন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আবাসিক এলাকার অভ্যন্তরে পাইপলাইন স্থাপন করা হলে চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদিত পানি গ্রাহকগণের অনুকূলে স্বতন্ত্র সংযোগ প্রদান করা যাবে।
তাছাড়া ইতোপূর্বে সিডিএ’র বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসা হতে জমাভিত্তিক পদ্ধতিতে পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদিত পানি সিডিএ কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় সরবরাহের ক্ষেত্রে ওয়াসার বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত মতে পূর্বের ন্যায় জমাভিত্তিক কাজ গ্রহণ করা হয়, কিংবা সিডিএ কর্তৃক আবাসিক এলাকার অভ্যন্তরস্থ পাইপলাইন স্থাপন করা হলে প্রতিটি প্লটে সুপেয় পানির সংযোগ প্রদানে চট্টগ্রাম ওয়াসা হতে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পূর্বকোণ/ইব