চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

অনিশ্চিত জীবনে ৫৭ প্রবাসী

মোহাম্মদ আলী

১৯ নভেম্বর, ২০২৪ | ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

সাইদুল হক সাঈদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল আইন শহরে বিগত ২২ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। রাউজানের হরিশ খান পাড়ার এ বাসিন্দা দীর্ঘ এ সময়ে তিনি আল আইনের সানাইয়ায় দুইটি স্টিল ও একটি গাড়ির ওয়ার্কশপ দেন। একইসাথে তিনি আবুধাবীতে ফ্লাটের ব্যবসাও করতেন। তার চারটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পূঁজি রয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। তাতে কর্মরত আছেন প্রায় ৩৫ প্রবাসী। প্রবাসে তার সাথে থাকতেন পরিবারও। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান নিয়ে সেখানে তার সুখের সংসার।

 

কিন্তু গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিক্ষোভ করলে সেখানে গ্রেপ্তার হন সাইদুল হক সাঈদসহ ৫৭ জন প্রবাসী। সেদেশের আদালত তাদের সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজাও দেন। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর গত ২৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। কারাদণ্ড প্রাপ্ত বাংলাদেশিদের মুক্তি দিতে তখন অনুরোধ জানিয়েছিলেন ড. ইউনূস। এর কয়েক দিনের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ প্রবাসীর সাজা মওকুফ করে ঘোষণা করে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার।

 

এরপর সাজাপ্রাপ্ত প্রবাসীরা কয়েক দফায় দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু দেশে ফিরে প্রবাসী সাইদুল হক সাঈদসহ সবাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আমিরাতে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি থাকায় তারা সবাই পুনরায় ফিরতে চান সে দেশে। কিন্তু বিদেশ গমনে তাদের বিরুদ্ধে আমিরাত সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা সেদেশে ফিরে যেতে পারছেন না। এ অবস্থায় আমিরাত ফেরত প্রবাসীরা দেশে এক অনিশ্চিত জীবন পার করছেন। আদৌ আমিরাতে গিয়ে নিজেদের ব্যবসা কিংবা চাকরি করতে পারবে না কিনা এ নিয়ে চরম অনিশ্চিয়তার মধ্যে রয়েছেন।

 

সাইদুল হক সাঈদ এর মতো দেশে এসে অনিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করছেন হাটহাজারীর পূর্ব মেখল গ্রামের বাসিন্দা প্রবাসী গাজী মাহফুজুর রহমান। আমিরাতের শারজাহ স্টেটে একটি গাড়ির গ্যারেজ ও একটি লন্ড্রি এবং আজমান স্টেটে একটি গাড়ির গ্যারেজ রয়েছে। বিগত পাঁচ বছর যাবত তিনি তিলে তিলে এ সম্পদ গড়ে তোলেন। বর্তমানে তিনটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বাজার মূল্য হবে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন কোটি টাকা। সেখানে কর্মরত রয়েছে ২১ জন প্রবাসী। কিন্তু প্রবাসী গাজী মাহফুজুর রহমান দেশে চলে আসার কারণে তার সবগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে গেছে। সেখানে কর্মরত কেউ কেউ ভিসা জটিলতায় পড়েছেন। আমিরাতে গাজী মাহফুজুর রহমানের সাথে মা-বাবা বসবাস করলেও তারাও দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

 

সাইদুল হক সাঈদ ও গাজী মাহফুজুর রহমানের মতো আমিরাত ফেরত ৫৭ প্রবাসী দেশে এসে এখন অনিশ্চিত জীবন পার করছেন। ইতোমধ্যে তাদের থেকে ৪৭ জন এবং একই সমস্যায় কাতার থেকে দেশে ফেরা অন্য দুইজন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার, চট্টগ্রামে লিখিত আবেদন করেছেন। আবেদনকৃত ৪৯ জনের মধ্যে ৪৫ জনই পুনরায় স্ব-স্ব কর্মস্থলে ফিরতে চান। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সেসব সেদেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা চরম অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে গেছেন।

 

প্রবাসী সাইদুল হক সাঈদ ও গাজী মাহফুজুর রহমান দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমিরাতে আমাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও পরিবার রয়ে গেছে। কিন্তু বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা ফিরতে পারছি না। এ অবস্থায় দেশে এসে আমরা অনিশ্চিত জীবনযাপন করছি। বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সরকার আমাদের সেদেশে পুনরায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করলে ৫৭ জন রেমিটেন্স যোদ্ধা অনিশ্চিত জীবন থেকে রক্ষা পাবে।’ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার, চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. এনায়েত উল্যাহ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের মধ্যে ৪৯ জন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার, চট্টগ্রামে লিখিত আবেদন করেছেন।

 

আবেদনকৃত ৪৯ জনের মধ্যে ৪৭ জন সংযুক্ত আরব আমিরাতের এবং দুইজন কাতারের। এর মধ্যে ৪৫ জন প্রবাসী পুনরায় স্ব-স্ব কর্মস্থলে ফিরতে চান। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সেসব দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা ফিরে যেতে পারছেন না। এ অবস্থায় তারা প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের প্রত্যাশা ও অভিব্যক্তি সরাসরি উপস্থাপন করতে চায়।’ প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিক্ষোভ করেন। পরে আমিরাতের আদালত ৫৭ জন বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং বাকি একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

 

উল্লেখ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও সভা-সমাবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। মিছিল, মিটিং বা প্রতিবাদ সমাবেশের চেষ্টা করা বা উস্কানি দিলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট