প্রচার-প্রচারণার দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভোটের মাঠ। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের ঘিরে প্রতিদিনই সংঘাত, সংঘর্ষ ও গোলাগুলিসহ রক্তক্ষয়ী সহিংসতার ঘটনা লেগে রয়েছে। এতে ভোটের আগেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটাররা।
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপিবিহীন নির্বাচনকে উৎসমুখর ও অংশগ্রহণমূলক করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সেই ঘোষণার পর বেশির ভাগ আসনে নৌকা প্রতীকের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী। কিন্তু প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকেই সহিংসতার ঘটনা লেগে রয়েছে। এতে দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার শামিল।
নির্বাচনে কোনো রকমের সংঘাত না করতে দলীয় প্রার্থীদের সতর্ক করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণ যাকে ভোট দেবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন। আওয়ামী লীগের কেউ সংঘাত করলেও রেহাই নেই। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ও চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন নিয়ে চিন্তিত ইসি। প্রচারণার শুরু থেকেই এই দুটি আসনে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পটিয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী (নৌকা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর (ঈগল) সমর্থকদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘাত-সংঘর্ষ, ক্যাম্প ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা লেগে রয়েছে। সহিংসতার ঘটনায় অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করে আসছেন দুই প্রার্থী।
গতকাল শুক্রবার খুলনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যেকোন মূল্যে নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করা হবে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে রিটার্নিং অফিসারদের মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
নির্বাচন কমিশনের চট্টগ্রামের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসন নিয়ে বড় টেনশনে রয়েছি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এই এলাকার সন্তান। সিইসির আসনে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে আমাদের সারাদেশে নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।’
চট্টগ্রাম-১ আসনে গতকাল মিরসরাই উপজেলায় পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। দুপুর ১২টায় উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডে স্বতন্ত্র প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের কর্মীদের মারধরের অভিযোগ করা হয়েছে। এজন্য নৌকার প্রার্থীকে দায়ী করেছেন গিয়াস উদ্দিন।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মোতালেবকে ঘিরে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। ভোটের মাঠে প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়ে দুই প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার সাতকানিয়ার চরতী ইউনিয়নে প্রচারণার সময় হামলার শিকার হন বর্তমান সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিনের স্ত্রী রিজিয়া বেগম, শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরী চেয়ারম্যানসহ অন্তত ২০ জন। একাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এজন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবকে দায়ী করেছেন এমপি নদভীর স্ত্রী।
মনোনয়নপত্র জমাদানের পর থেকেই সাতকানিয়ায় রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে আসছে। চরতী ও ঢেমশা ইউনিয়নে নৌকা ও ঈগল প্রতীকের দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তাপ-উত্তেজনা ও সহিংসতা লেগে রয়েছে। পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিদুয়ানুল ইসলাম সুমনের বসতঘরে গুলি ছোড়া ও হত্যার চেষ্টা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোতালেলেব ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। এজন্য নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের দায়ী করেছেন ঈগল প্রতীকের প্রার্থী মোতালেবের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আ ম ম মিনহাজুর রহমান।
নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার শুরুতেই আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা লেগে রয়েছে। ভোটের দিন ঘনিয়ে আসতেই সহিংসতার ঘটনাও বেড়ে চলেছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ভোটের মাঠ। ইতিমধ্যেই পাঁচ আসনে সহিংসতার ঘটনায় উত্তাপ ছড়াছে।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের প্রতিনিয়ত সহিংসতা লেগে রয়েছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ইউনিয়নে ক্যাম্প ভাঙচুর, স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুর হক চৌধুরীর গাড়িবহরে হামলা, ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন সাধারণ জনগণ-ভোটাররা। প্রচারণা শুরু থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১০টি ঘটনার ঘটেছে। গতকাল শুক্রবার জিরি এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরী ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী ও আ. লীগ প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম সহিংসতার ঘটনায় পরস্পরকে দায়ী করেছেন।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এবার কিংস পার্টিখ্যাত ছোট ছোট দলের অংশগ্রহণ বেশি রয়েছে। বড় অংশ রয়েছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন ইসলামী দলগুলো। কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লড়াইয়ে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছেন কিংসপার্টির প্রার্থীরা।
চট্টগ্রামের ১৬ আসনের মধ্যে ১১টিতে আওয়ামী লীগ ও জোট প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। এরমধ্যে ৫টি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের ঘিরে উত্তাপ-উত্তেজনা ভোটের আগে থেকেই চলে আসছে। এসব আসনের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসন নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বাচিপের কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর (ঈগল) সমর্থকদের মধ্যে ইতিমধ্যেই চারটি সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার ঘটনায় মামলা হয় থানায়।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমানের (ঈগল) কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসময় ইট-পাটকেল নিক্ষেপে দুই পক্ষের চার কর্মী আহত হয়েছেন।
পূর্বকোণ/পিআর