চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৭ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামে দৈনিক গড়ে ৮-১০ অপরিণত শিশুর জন্ম

সংকটে অপরিণত শিশুর চিকিৎসা

ইমাম হোসাইন রাজু

১৭ নভেম্বর, ২০২৩ | ১১:১৩ অপরাহ্ণ

বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পর মো. আজাদ-হাবিবা দম্পতির ঘরে জন্ম হয় ছেলে সন্তানের। তাও আবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই (অপরিণত শিশু) পৃথিবীর আলো দেখে নোয়াখালীর বাসিন্দা এ দম্পতির প্রথম সন্তান।

 

কিন্তু জন্মের পরপরই নবজাতকটির শ্বাসকষ্টসহ দেখা দেয় বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা। প্রয়োজন হয় এনআইসিইউ সাপোর্টের। কিন্তু স্থানীয় সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন হাসপাতালে এ সেবার সুযোগ না থাকায় প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালে। তাতেও মেলেনি শয্যা। যদিও বহু কষ্টে বেসরকারি একটি হাসপাতালে শয্যায় ঠাঁই মিলে তার। তবে তৎক্ষণাত শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয় এ নবজাতকের। শুধু তাই নয়, বেসরকারি হাসপাতালের একদিনের খরচের চাপ সামাল দিতেই কাহিল অবস্থা স্বজনদের।

 

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থা হওয়ায় স্বজনরা নবজাতকটিকে নিয়ে যায় সেখানে। কিন্তু শিশুটির শারীরিক অবস্থা তখন ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এনআইসিইউ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে নিতে হয় তাকে। প্রায় দু’সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় এ নবজাতককে।

 

চিকিৎসকরা জানান, আজাদ-হাবিবা দম্পতির ঘরে জন্ম নেওয়া অপরিণত শিশুটির জন্মের পরপরই অক্সিজেনসহ এনআইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া গেলে হয়তো বাঁচানো যেত। কিন্তু সহজলভ্য না হওয়ায় এ দম্পতির মতো প্রতিনিয়তই অনেক অপরিণত নবজাতককে বাঁচানো যাচ্ছে না।

 

জানা যায়, সরকারিভাবে নবজাতকের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১২৪ শয্যার নবজাতক বিভাগে। যদিও শয্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকে বিভাগটিতে। এরমধ্যে ১০০ শয্যার এনআইসিইউ ও ২৪ শয্যার ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) বিভাগ আছে। বেসরকারিভাবে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ৭০ শয্যার নবজাতক বিভাগে ৪০ শয্যার এনআইসিইউ আছে। ছোট-বড় কিছু বেসরকারি হাসপাতালে এনআইসিইউ সুবিধা থাকলেও শয্যা বাবদ গুণতে হয় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। যা গরিব-অসহায় রোগীদের পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

 

শুধু তাই নয়, অপরিণত শিশুর প্রাণ বাঁচাতে জরুরি চিকিৎসা সেবা হলো এনআইসিইউ সাপোর্ট। কিন্তু চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কিংবা চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও কোনটিতেই নেই নবজাতকের চিকিৎসার ব্যবস্থা কিংবা এনআইসিইউ সুবিধা। এছাড়াও পাশ্ববর্তী জেলা হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোনটিতেও এ সেবা নেই। এ কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম বাড়লেও সে তুলনায় বাড়ছে না চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ।

 

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পূর্বের চেয়ে অপরিণত শিশুর জন্মের হার তুলনামূলক বেড়েছে। চট্টগ্রামে প্রতিদিনই গড়ে ৮ থেকে ১০ জন শিশুর জন্ম হচ্ছে অপরিণত অবস্থায়। যাদের মধ্যে অর্ধেকের চেয়ে বেশি জন্ম হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়াও চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা নবজাতকের বড় অংশই আসে গ্রামাঞ্চল থেকে। মূলত গ্রামাঞ্চলে নবজাতকের জন্ম হলেও অপরিণত শিশুর চিকিৎসার তেমন কোন ব্যবস্থাই নেই কিংবা চিকিৎসা সহজলভ্য নয়। জন্মের পরপরই এসব মুমূর্ষু অপরিণত শিশুর অক্সিজেন সাপোর্ট ও এনআইসিইউ’র প্রয়োজন হলেও তার সুযোগই নেই গ্রামগঞ্জে কিংবা জেলা পর্যায়েও। তাতে করে বাধ্য হয়েই দূরের পথ পাড়ি দিয়ে স্বজনদের ছুটতে হয় চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায়।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শাহীন বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে দশজন নবজাতক এলে তাদের মধ্যে এক কিংবা দু’জন থাকে অপরিণত শিশু। যারা অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে আসেন। কিন্তু আসতে আসতে অনেক সময় তাদের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। তখন তাদের বাঁচানোও কঠিন হয়ে পড়ে। কিংবা সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে শারীরিক নানান ক্ষতিও হয়ে থাকে তাদের। এটি কমাতে সচেতনতার বিকল্প নেই।

 

চিকিৎসকরা জানান, গর্ভাবস্থার মেয়াদ সাধারণত ৪০ সপ্তাহ ধরা হয়। কিন্তু সব শিশুই যে পূর্ণ সময়, অর্থাৎ ৪০ সপ্তাহ পার করে ভূমিষ্ঠ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নবজাতক জন্ম নেয়। দু’-এক সপ্তাহ এদিক-ওদিকে বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু ৩৭ সপ্তাহের আগেই যে শিশু জন্ম নেয়, তাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ‘প্রি-ম্যাচিউরড বেবি’। এই শিশুদের এবং তাদের মায়েদের তখন বিশেষ যত্মআত্তির প্রয়োজন।

 

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মু. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার পাশাপাশি বিভাগের কুমিল্লা, নোয়াখালী থেকে শুরু করে টেকনাফ ও পাবর্ত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকেও অনেক শিশু আসে। যাদের সিংহভাগই মুমূর্ষু থাকে। অনেক সময় শয্যা খালি না থাকায় বাধ্য হয়েই এসব নবজাতককে ভর্তি দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার অনেক নবজাতক সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে না আসার কারণে জটিলতাও বেড়ে যায়। ততক্ষণে ভর্তি করানো হলেও অনেক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নবজাতকটি। এজন্য অবশ্যই অপরিণত শিশু জন্মের পরপরই তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি।’

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট