চট্টগ্রাম সোমবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

গণপরিবহনে শতকরা ৯৯ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার

মরিয়ম জাহান মুন্নী

১৩ জুলাই, ২০২৩ | ১১:০০ পূর্বাহ্ণ

২ নম্বর বাসে মোহরা থেকে মুরাদপরে টিউশন করতে আসছিলেন শিক্ষিকা তাবিয়্যাহ তাসবীহ রুপা। গাড়িতে উঠার সময় কয়েক জন মানুষের ভীড়ে হেলপার তার পিঠ চেপে ধরে গাড়িতে উঠতে বললে তিনি রেগে গিয়ে প্রতিবাদ করেন। তখন হেলপারসহ কিছু যাত্রী মন্তব্য করেন ‘লোকাল বাসে উঠলে গায়ের সাথে লাগবেই, সহ্য না হলে সিএনজি, রিকশা নিয়ে চলেন’।

 

আবার আগ্রাবাদে সরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আঁখি খন্দকার। তিনি বলেন, সকালে বাসে খুব ভীড় থাকে। অফিস যাওয়ার জন্য তখন বাসে উঠতে পারাটা ছোটখাট একটা যুদ্ধ জয় করার সমান। শহরের বাসের পরিস্থিতি কি তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। যখন বাসে উঠবো, তখন প্রায়শই ধাক্কার সাথে বেশ কিছু অসংবেদনশীল শব্দ কানে ভেসে আসে। এটা রোজই ঘটে। প্রতিবাদ করলেও তিরস্কার সহ্য করতে হয়। তাই এখন এ বিষয়টিকে ডেইলি রুটিনের মধ্যেই নিয়ে নিয়েছি।

 

পোশাক কারখানায় কাজ করা মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি আরো ভয়াবহ। আকলিমা বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের বিপরীত পাশে অনেকক্ষণ গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। ভীড় দেখে তিনটা গাড়ি মিস করে। চতুর্থ গাড়িতে উঠার সুযোগ পেতেই তড়িগড়ি করে উঠার চেষ্টা করে তারা কয়েকজন। এদিকে, বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকছে হেলপার। উঠার সময় পেছন থেকে আকলিমার কোমরে থাপ্পড় দিয়ে হেলপার বলতে থাকে উঠেন উঠেন! রাগ হলেও লজ্জায় কিছু বলেননি তিনি। এদের মতো এমন আরো কয়েকজন নারীর সাথে কথা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা এবং বিভিন্ন বয়সের সেই নারীদের মধ্যে এমন কেউই ছিলেন না যিনি গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হননি।

 

পোশাক শ্রমিকদের তথ্য অনুযায়ী, বাসে সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় তারা। উঠার সময় শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হেলপারদের স্পর্শ করা। কিছু বললে হাসি ঠাট্টা করে, নামার সময় আরো বদমায়শি করে। মহিলার সিট খালি না থাকলে দাঁড়িয়েই যাতায়াত করতে হয়। তখন বাসে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক পুরুষ যাত্রী আড়ালে গায়ে হাত দিয়ে থাকে। কিছু বললে তারাও গার্মেন্টসের মেয়ে বলে বাজে মন্তব্য করে।

 

নগরীতে চলমান লোকাল বাস, টেম্পু, লেগুনাসহ প্রায় সবরকম গণপরিবহনে নারীরা কমবেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকাল বাসে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক  কমিটি ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে ৯৯ জন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, সারাদেশে ২০২১ সাল থেকে ২০২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপরিবহনে ৭০টির বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে প্রায় ৪২টি ধর্ষণ এবং ৪৩টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। বলা বাহুল্য এসব তথ্যের মধ্যে বড় একটি অংশই উঠে আসেনি। পরিস্থিতির শিকার নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখ বুঝে সহ্য করে নেন এসব হয়রানি।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেলে কর্মরত নার্স নাইরা সুলতানা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী পলি মজুমদার বলেন, গাড়িতে অনেক সময় পুরুষরা মহিলার সিটে বসে থাকে। উঠতে বললে বলে ‘নারী পুরুষ সমান অধিকার। তাহলে কেন দাঁড়িয়ে যেতে পারেন না।’ তবে আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। নারীরা নিজেই প্রতিবাদ করে। নারীদের পাশাপাশি পুরুষ যাত্রীদের মধ্যেও ইতিবাচক চিন্তাসহ সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, লোকাল বাসগুলোতে কর্মজীবী নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন অহরহ। হয়রানি বন্ধ করতে হলে কিছু নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। যেমন বাসগুলোকে রুট পারমিট দেয়ার সময় লোকাল বাস হিসেবে রুট পারমিট না দিয়ে কাউন্টার সার্ভিস হিসেবে দেয়া যায়। এতে পরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে। যার ফলে সমস্যা কমবে। আমাদের আওতাধীন গাড়িগুলোর ড্রাইভার, হেলপারদের এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বিভিন্ন সভা সেমিনারের মাধ্যমে। এমন অভিযোগ পেলে তাদের বরখাস্ত করা হয়।

 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মুছা দাবি করে বলেন, ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে এ সমস্যা কম। এর কারণ আমরা মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পেরেছি। আমরা ড্রাইভার, হেলপারদের বিভিন্ন সভা সেমিনারের মাধ্যমে সচেতন করি। কেউ এমন কিছু করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হয়। তবে একেবারে বন্ধ করতে হলে আইনের প্রয়োগ আরো বাড়াতে হবে। গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। নারীদেরও সচেতন হতে হবে। বিভিন্ন সড়কের মোড়ে সিসি ক্যামেরা নিশ্চিত করতে হবে।

 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, লোকাল বাসগুলোতে নারী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য মাত্র আটটি সিট রয়েছে। সংরক্ষিত সিটগুলোতেও পুরুষ যাত্রীরা বসে থাকে। যদিও এখন অনেক সচেতনতা বেড়েছে। লোকাল বাসে যৌন হয়রানি প্রতিদিনই কম বেশি হচ্ছে। গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পুরো পরিবহন ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলে আনতে হবে এবং নারীবান্ধব করতে হবে। গাড়িগুলোতে মালিক সমিতির কর্তব্যরত এবং যে রোডে গাড়ি চলে সেসব এলাকার সংশ্লিষ্ট থানার মোবাইল নম্বরের স্টিকার গাড়ির বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে রাখতে পারে যাতে কোনো নারী এমন ঘটনার শিকার হলে তাদেরও সহযোগিতা পায়।

 

হয়রানির শিকার হলে যা করবেন: সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজে প্রতিবাদ করবেন। ৯৯৯ মাধ্যমে কল করে সংশ্লিষ্ট থানায় জানাতে হবে। সুযোগ থাকলে কোনো বাস স্টেশনে ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতা নিতে হবে।

 

আইনি প্রতিকার

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আইনজীবী এডভোকেট জিন্নাত আমিন বলেন, লোকাল বাস কিংবা কোনো স্থানে কোনো নারী যদি হয়রানির শিকার হয় তাহলে নারী ও শিশু  নির্যাতন দমন আইন ২০০৩ অনুযায়ী ১০ ধারায় শ্লীলতাহানির জন্য মামলা রুজু করা যাবে। যেখানে বলা আছে কোনো নারীকে জোরপূর্বক শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে বা শরীরের স্পর্শকাতর কোনো জায়গায় হাত দিলে নুন্যতম ৩ বছর সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় করা হবে। তাই যদি কোনো নারী বাস, ট্রেনসহ কোথাও হয়রানির শিকার হয় তাহলে নারী ও শিশু  নির্যাতন দমন আইন ২০০৩’র ১০ ধারায় মামলা করতে পারবে।

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট