চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভালো নেই বিনয়বাঁশীর পরিবার

সেকান্দর আলম বাবর , বোয়ালখালী

৫ এপ্রিল, ২০২১ | ১:৪৬ অপরাহ্ণ

উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঢোলবাদক বিনয় বাঁশী জলদাশ। জেলে পল্লীতে জম্মগ্রহণকারী বিনয় বাঁশী ঢোল বাজনার জাদুতে মুগ্ধ শুধু বোয়ালখালীবাসীকে করেননি, দেশ পেরিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে উপমহাদেশেও। ঢোলের মনোমুগ্ধকর বাজনায় পারদর্শিতার স্বীকৃতিও কম মেলেনি। ২০টিরও অধিক পুরস্কার, ৫০টির অধিক সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

২০০১ সালে জাতীয়ভাবে একুশে পদক দিয়ে সরকার এ গুণী শিল্পীকে করেছেন সম্মানিত, গুণান্বিত। আজ ( ৫ এপ্রিল, সোমবার) এ গুণী শিল্পীর  ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। গত শনিবার প্রতিবেদক সরেজমিনে শিল্পীর বাস্তুভিটায় গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সদস্যদের সাথে। শিল্পীর নাতি, বিনয় বাঁশী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব জলদাশ জানান, ভাল নেই তারা। নেই ঘর, নেই শিল্প চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা। এখনও ঝুপড়ির মধ্যে বসবাস করতে হয় তাদের।

ছন্দারীয়া খালের ভাঙ্গণে যেটুকু ঘর ছিল, তাও বিলীন হওয়ার পথে। জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে ডাকঢোল পিটিয়ে সবাই আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে চলে যায়, পরে আর কারও খবর নেয়ার সময় হয় না। শিল্পীর মৃত্যুর পর দেড়যুগ এভাবেই গেল। এজন্য পেশা পরিবর্তন করে তারা জীবিকার জন্য অন্যপথ অবলম্বন করছেন। এতে হারাতে বসেছে ঢোলের ছন্দ আর তাল। তিনি বলেন, আগে প্রচুর প্রোগ্রাম পেতাম, করোনা আর ডিজিটাল যুগের কারণে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

অপর নাতি দোলন জলদাশ জানান, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে টিকে থাকতে পারতাম। এখন হাঁপিয়ে উঠেছি। দীর্ঘ একযুগে সরকারি সহযোগিতা বলতে খুবই নগন্য। ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে দাদুর ভাষ্কর্য নির্মাণ হয়। এজন্য স্মরণ করতে হয়, তৎকালীন বোয়ালখালীর ইউএনও, পরবর্তী জেলা পরিষদ সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া,  সাংবাদিক তাজুল ইসলাম রাজু, ভাষ্কর  ডি কে দাশ মামুন, আমার বাবা বাবুল জলদাশকে।  তিনি বলেন, ডিজাইনে সে সময় এটি খোলা ছিল, জেলা পরিষদের সদস্য মো. ইউনুস পরবর্তীতে ১ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়ে গম্ভুজ আকারে ছাদের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া ২০১০সালে প্রতিষ্ঠিত বিনয় বাঁশী শিল্পী গোষ্ঠীকে ২০১৯সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ১০ হাজার, ২০২০সালে ২০হাজার টাকা অনুদান দেয় এবং এককালীন দুই লক্ষ টাকা অনুদান দেয়।

সরেজমিনে শনিবার দেখা যায়, ২০১২সালে নির্মিত ভাষ্কর্যটি অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে। ডান হাতের একাংশ ভাঙ্গা। এককথায় এলোমেলোভাবে পড়ে আছে সমাধি প্রাঙ্গণ। নেই সুরক্ষার ব্যবস্থা। রং উঠে গেছে, টাইলস ভেঙ্গে গেছে। আজ ( সোমবার) মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। রাস্তা থেকে সমাধি ডিঙ্গিয়ে একটু এগিয়ে যাওয়া হয় বাস্তুভিটায়। এখানে আরও করুণ অবস্থা। ছন্দারিয়া খালের ভাঙ্গণে যায় যায় অবস্থা বিনয় বাঁশীর ছেলেদের ঘরগুলো। ভিটের অনেক অংশ ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে খালের সাথে।  পলিথিন, তেরপাল দিয়ে কোনোরকমে ঢাকা হয়েছে ঘরগুলো। দু’পাশে ঘর, হাঁটাচলার জায়গাটুকুই নেই। ঘরের বেড়াগুলো কাতরাচ্ছে যেন, অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কথা হয় বিনয় পরিবারের বৌ ঝি’দের সাথে। কথারভাবে ফুটে উঠেছে, তারা পারেননি মাছ ধরার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে, পারেনি ঢোল আর ছন্দের বাদ্য বাজনার জৌলুস ধরে রাখতে। যা আছে, তাও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।

শিল্পীপুত্র বাবুল জলদাশ জানান, বাবার মৃত্যুর পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. মোরশেদ খান, প্রয়াত সাংসদ মঈন উদ্দিন খান বাদল, বর্তমান সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমদ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, নিজেরা শিল্পীর বাস্তুভিটা পরিদর্শন করে নদী ভাঙ্গণ রোধের ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। দীর্ঘ ২০বছরে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, দুই সরকারের উল্লেখিত সাংসদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা একটি কমপ্লেক্স করার ঘোষণা দিয়েছিলেন একাধিকবার। এটি আজও আলোর মুখ দেখেনি।

জম্ম ও মৃত্যু: বিনয় বাঁশীর জন্ম ১অক্টোবর ১৯১১ সালে, বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব গোমদ-ী ছন্দারিয়া খাল পাড়ের জেলে পল্লীতে। পিতার নাম উপেন্দ্র লাল জলদাস, মাতার নাম সরলা বালা। বিনয় বাঁশীর স্ত্রী’র নাম সুরবালা জলদাস। তিনি ছয় পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। এর মধ্যে দুই পূত্র বাবুল আর হরিলাল বাবার পেশাকে ধারণ করে ঢোল বাজনার শিল্পকে টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০২ সালের ৫এপ্রিল, দিবাগত রাত দেড়টায় শিল্পী তাঁর নিজ ভিটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শিক্ষা ও পেশা : পৈতৃক পেশা জেলে, সুতরাং জীবন ও জীবিকার তাগিদে এ কর্মে জড়িয়ে পড়া, লেখাপড়া তেমন একটা হয়নি। অ, আ, ক, খ’তেই সীমাবদ্ধ ছিল শিক্ষা। সচরাচর ঢোল বাজনায় অতিপ্রেম ছিল তাঁর। নিবিড় সাধনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া ঢোল বাজনার নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করে নিজেকে গড়ে তোলেন ঢোল বাদনের প্রকৃত শিল্পী হিসেবে। রায়খালীর লক্ষীন্দর ও ত্রিপুরা জলদাসের কাছে তালিম নিয়ে তিনি প্রথম যন্ত্র সংগীত জগতে নিজেকে উপস্থাপন করেন।

১৯১১ সাল থেকে ২০০২ দীর্ঘ ৮২ বছর ঢোলের তালেই কাটিয়ে দেন এ বাদন শিল্পী। আর্থিক অনটন, শত প্রতিকূলতা কোন কিছুই আঁচ করতে পারেনি শিল্পীকে। নিজেকে মেলে ধরার সুযোগও তাঁকে হাতছানি দিয়েছে। এপার-ওপার বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিয়াল রমেশ শীলের সান্নিধ্যে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য রকম  এক উচ্চতায়। কবিয়াল রমেশ শীল দোহার হিসেবে নেন বিনয়কে।  শিল্পীর সাথে শিল্পীর প্রেমে তিন যুগেরও বেশি সময় সংস্কৃতিপ্রেমিরা পেয়েছে অমর কিছু সৃষ্টি। যেগুলোকে পুঁজি করে গবেষণা হচ্ছে, নতুন কিছু সৃষ্টির প্রয়াস হচ্ছে, উদ্দীপনার খোরাক হচ্ছে লক্ষ কোটি সংস্কৃতিসেবীর মন মাজারে। এই বাদন শিল্পী ছুটে বেরিয়েছেন উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে। ঢোলের পাশাপাশি সানাই, বেহালা, দোতারা, করতাল, মৃদঙ্গ বাজানোতেও পারদর্শিতা ছিল তাঁর। ঢোল বাজানো ছাড়াও তিনি শতাধিক লোকগীতি রচনা করেন।

ঢোলের ভাষা : সবাইতো ঢোল বাজায় কিন্তু কি ছিল বিনয়ের ঢোলে? ছিল শোষিত নিপীড়নের কথা; , দেশ মাতৃকার কথা, ছিল প্রেম বিরহের কথা, ছিল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদ। তার বাস্তুভিটায় এখন পরম যত্নে  সংরক্ষিত আছে শিল্পীকে শিল্পী বানানোর সেই পূজনীয় ঢোলটি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট