চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

ঈদ মুবারক আস-সালাম

আবসার মাহফুজ

২০ এপ্রিল, ২০২৩ | ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ওগো কাল সাঁজে দ্বিতীয়া চাঁদের ইশারা কোন

মুজদা এনেছে, সুখে ডগমগ মুুকুলী মন।

আশাবরী সুরে ঝুরে সানাই,

আতর সুবাসে কাতর হল গো পাথর দিল,

দিলে দিলে আজ বন্ধকী দেনা নাই দলিল,

কুবুলিয়তের নাই বালাই।’

ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। মুসলিম-বিশে^র শ্রেষ্ঠ আনন্দ উৎসব এই ঈদ, ঈদুল ফিতর। সাম্যের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আর এই ঈদ আসে মানুষের অন্তরকে সাম্যবাদের শিক্ষায় পরিপুষ্ট করে। সকল ইন্দ্রিয়কে শৃঙ্খলিত করে। সুদীর্ঘ একমাস সংযম আর কৃচ্ছ্রতা সাধনের পর, দিনে নিরন্তু উপবাস, রাতে ইবাদত, অভাবীদের প্রতি সাধ্যমত দানখয়রাত- এভাবে মাসব্যাপী নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকে শৃঙ্খলিত রাখার পর ঈদ নিয়ে আসে মুক্তির বারতা, আনন্দের ফল্গুধারা। কঠোর সিয়াম সাধনার পর ঈদের একফালি বাঁকা চাঁদ বয়ে আনে খুশির মধুময় সওগাত। সারা মুসলিম দুনিয়ায় এদিন মহানন্দের জোয়ার বয়ে যায়। প্রতি মুসলমানের দরজা সেদিন উন্মুক্ত থাকে সর্বশ্রেণির মানুষের জন্যে। শত্রুমিত্র সকলেই সেদিন সকলপ্রকার দ্বেষ ভুলে বুকে বুক মিলায়, প্রাণে প্রাণ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উল্লিখিত কবিতার চরণগুলোয় সে চিত্র ফুটে উঠেছে।

ইসলামে সুস্থ জীবনের জন্যে প্রয়োজন এমন সব বিষয়কে অনুমোদন করেছে। আর আনন্দ উল্লাস যেহেতু শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যে অপরিহার্য সেহেতু ইসলাম ন্যায়সঙ্গত সকল আনন্দ উৎসবকে অনুমোদন দিয়েছে এবং মাসব্যাপী কঠোর সিয়াম সাধনার পর ঈদ-উৎসব পালন সকলের জন্যে অপরিহার্য ঘোষণা করেছে। আনন্দের এই বিশেষ দিনটিতে রোজা রাখাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে উৎসবের ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ার আশংকায়। এই উৎসব ইসলামী সংস্কৃতির পরিচ্ছন্ন ও পরিমার্জিত একটি অংশ। আনন্দ-উল্লাসকে ইসলাম উপেক্ষা করে না বলেই রোজার পর ঈদের প্রচলন রয়েছে। ইসলামের প্রবর্তক রসুলে করীম (স.) আনন্দ-ফূর্তি, হাসি-খুশি থাকা পছন্দ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে পানাহ্ধসঢ়; চাই দুশ্চিন্তা ও দুঃখানুভূতি থেকে।’ কিন্তু বাংলাদেশে সর্বজনীন ঈদ উৎসব পালনে অনেক ক্ষেত্রে এবং অনেকের মধ্যে কৃপণতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। এর মূলে রয়েছে আমাদের দেশে আসল ইসলাম সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানের অভাব। এদেশে একশ্রেণির আলেম ইসলামকে জনগণের কাছে একটি কঠিন ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অনেকে জেনে বা না জেনে ইসলামকে বৈধ উপায়েও আনন্দ প্রকাশের বিরোধী মনে করে থাকেন। তারা আনন্দ উৎসবকে ইসলামবিরোধী মনে করে থাকেন। সুশৃঙ্খল আনন্দ উৎসব সুস্থ সমাজের জন্যে কতটুকু উপযোগী তা তাদের মাথায় আসে না; যার কারণে রোজা আর ঈদকে এক করে ব্যাখ্যা করে থাকেন। ত্যাগের পরিণতি যে পরিশীলিত আনন্দ ও ভোগ তা তাদের চিন্তায় ধরা দেয় না। তারা মনে করেন দুনিয়ায় কোন আনন্দ নেই, ভোগ নেইÑ শুধু ত্যাগ আর ত্যাগ। যার কারণে পরস্পর কোলাকুলি আর সেমাই খাওয়ার মধ্যেই অনেকের ঈদ উৎসব সীমিত থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত দার্শনিক আবুল মনসুর আহমদ এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘রোজা এবং ঈদ ত্যাগের ও ভোগের মতোই দুইটি এন্টিথিসিস, বিপরীত গুণাত্মক কাজ। রমজানের বেলায় একটা শর্ত আর একটা পুরষ্কার। একটা ক্রিয়া আর একটা ফল। শ্রমের পুরষ্কার যেমন বিশ্রাম, ত্যাগের পুরস্কার তেমনি ভোগ, রমজানের রোজার পুরস্কার তেমনি ঈদুল ফিতর। আমরা দুটোকে এক করে ফেলেছি।’

ইসলাম মানুষকে কঠোর সাধনার পাশাপাশি পরিশ্রান্ত দেহের জন্যে বিশ্রাম, ভোগ ও আনন্দেরও ব্যবস্থা করেছে। যাতে সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে সুস্থসমাজ গড়া যায়। আর এই কারণে মাসব্যাপী কঠোর সিয়াম সাধনার পর ঈদ উৎসবের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের একটি শ্রেণি ঈদকে কয়েকটি প্রথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে। অথচ ইসলামের সোনালী যুগে অত্যন্ত ঘটা করে আমাদের দেশে ঈদ উৎসব পালিত  হতো। ঈদের দিনে সমস্ত মুসলমান আনন্দ ফূর্তিতে মশগুল থাকত। স্ত্রী-পুরুষ বালক-বালিকা নির্বিশেষে প্রত্যেকে নতুন এবং উৎকৃষ্ট কাপড় পরিধান করতো। চমৎকার পোশাক পরিচ্ছেদে সজ্জিত হয়ে মুসলমানগণ প্রভাতে ঈদগাহ ময়দান বা ঈদের নামাজের স্থানে শোভাযাত্রা করে গমন করত। মীর্জা নাথন তাঁর ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’ গ্রন্থে ১৫-১৬ শ’ খ্রিস্টাব্দের ঈদ উৎসবের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন- খুব আমোদ-ফূর্তির সাথে ঈদের নতুন চাঁদকে স্বাগত জানানোর কথা। দিনের শেষে, সন্ধ্যা সমাগমে নতুন চাঁদ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় নাকারা বেজে ওঠে এবং গোলন্দাজ সেনাদলের সকল আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ক্রমাগত তোপ দাগানো হয়। রাত্রির শেষ ভাগে কামানের অগ্নুদগীরণ শেষ হয়। এরপর শোনা যায় ভারি কামানের  আওয়াজ। এটা ছিল দস্তুর মত ভূমিকম্প। এর সঙ্গে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনের ব্যবস্থাও থাকতো।

অতীতে বাংলাদেশের ঈদ উৎসবগুলোতে ইসলামের বাস্তবমুখী শিক্ষাকে পুরোপুরি অনুসরণ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে আমরা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে যেনো অনেক দূরে সরে গেছি। মুসলমানদের বহু উপাদান আজ পরিচর্যা এবং গোঁড়ামির কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। ঈদ আমাদের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবের নামে যে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, কথকতা, কাব্য, নাটক, মেলা প্রভৃতি সংস্কৃতির চর্চা হবে, সেগুলোইতো অন্যদের আকৃষ্ট করবে। আর এভাবেই ধর্মীয় উৎসব জাতীয় উৎসবে পরিণত হবে। ঈদ উৎসব আমাদের জীবনের সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সৃজনশক্তি ও উৎসাহের অভাবে বন্ধ্যা হয়ে গেছে। এই বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে ঈদকে মুসলিম সংস্কৃতির প্রাণশক্তিতে রূপান্তরের উদ্যোগে নিতে হবে। আর এর জন্যে ঈদকে সিয়াম হিসেবে নয়, উৎসব হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। গ্রহণ করতে হবে মাসব্যাপি কঠোর সিয়াম সাধনার পর মহানন্দের দিন হিসেবে।

আবার ঈদ আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি মানবজাতির মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সৌহার্দ্য-ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক সম্প্রীতি, সাম্যচেতনা ও মহামিলনের বার্তা নিয়ে আসে বিশ্বজনের দ্বারপ্রান্তে। এদিনে মসজিদ-ঈদগাহে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। ঈদের নামাজশেষে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কে ধনী, কে নির্ধন, কে পরিচিত, কে অপরিচিত- এমন বাছবিচার প্রশ্রয় পায় না মনে। ভেদাভেদ, মনোমালিন্য, ঈর্ষা-বিদ্বেষ ও সংকীর্ণ হীনস্বার্থের গ্লানি হতে মুক্ত হয় সবার মন। আর এটাই ঈদ উৎসবের শাশ্বত কল্যাণ-দর্শন। আর ঈদের আগে যাকাত দেয়ার যে চেতনা ও মর্মবাণী, তা সেবাধর্মেরই মর্মবাণী। ইসলামে যাকাত দানের বাধ্যবাধকতা উন্মুক্ত করে দেয় দারিদ্র্য জয়ের পথ। তবে প্রশ্নটি হচ্ছে, ইসলাম নির্দেশিত পথে কী জাকাত দেয়া হয়? যদি যথানিয়মে জাকাত আদায় করা হতো তাহলে দেশে দরিদ্রমানুষের সংখ্যা দ্রুতই কমে যেতো। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, ঝগড়া-বিবাদ ও সকলপ্রকার অন্যায় অপকর্ম হতে বিরত থেকে পরম আত্মিক আনন্দ অর্জন করার মধ্যেই ঈদের শিক্ষা নিহিত। মানবিকতার সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার ক্ষেত্রে সিয়াম ও ঈদের যে শিক্ষা, তা আমরা সত্যিই জীবনে ধারণ করতে পেরেছি কি না- আজ আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা দরকার।

 

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট