ঈদের লম্বা ছুটিতে পর্যটন নগরী কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলা- বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পর্যটক বরণে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে টানা বর্ষণ আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার আশানুরূপ পর্যটকের আগমন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পূর্বকোণের কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি সংবাদদাতারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান- ঈদ উপলক্ষে কক্সবাজারে আগাম বুকিং আশানুরূপ হলেও সেন্টমার্টিনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় পর্যটকের আগমন কমে যেতে পারে। অন্যদিকে রাঙামাটিতে সাজেক, কাপ্তাই লেক ও সুবলং ঝর্ণা ঘিরে পর্যটক আগমনের ব্যাপারে আশাবাদী ব্যবসায়ীরা। যদিও আবহাওয়ার কারণে পর্যটক নিয়ে অনিশ্চিয়তা রয়েছে- তবুও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত এখানকার পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
বান্দরবানে অধিকাংশ হোটেল-রিসোর্ট ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বুকিং হলেও পাহাড় ধস ও সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে কিছু এলাকায় ভ্রমণে সতর্কতা জারি রয়েছে। তবে খাগড়াছড়িতে পর্যটন কেন্দ্রগুলো নতুন সাজে প্রস্তুত হচ্ছে; নিরাপত্তা নিশ্চিতে মোবাইল টিমসহ পর্যাপ্ত ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলে জানা গেছে।
এরফান হোছাইন, কক্সবাজার প্রতিনিধি
এবারের ঈদুল আজহার টানা ১০ দিনের ছুটিতে কক্সবাজার সৈকতে কয়েক লক্ষাধিক পর্যটকের ঢল নামার প্রত্যাশা থাকলেও, তার ব্যতিক্রম ঘটতে পারে বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, মূলত সেন্টমার্টিন ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই পর্যটকেরা কক্সবাজারে আসেন। সেন্টমার্টিনে পর্যটক নিষিদ্ধের কারণে পর্যটন খাতে ব্যবসা মন্দা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেন্টমার্টিন ইউরো বাংলার এমডি আজিজুল হক বলেন, কক্সবাজারে পর্যটক আসার মূল আকর্ষণ হচ্ছে সেন্টমার্টিন। যেখানে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবার কক্সবাজারে পর্যটকের সংখ্যা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। হোটেল ব্যবসায়ীরা জানান, কক্সবাজার শহর ও আশপাশের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউসে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার পর্যটকের রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে হোটেলের কক্ষ ভাড়ায় ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় চলছে। তবে, ঈদের দিন থেকে সেই সুযোগ থাকবে না বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক আবুল আলা ফারুকের মতে, ১০ দিনের ছুটি থাকলেও কক্সবাজারের পর্যটন জমবে মাত্র পাঁচদিন মূলত ৯ জুন থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত। তারকা হোটেলগুলোতে ৫-৮ জুনের জন্য রুম বুকিং কম থাকলেও, ৯-১৩ জুনের বুকিং বেশি আসছে এবং এসময় ৮০-৯০ শতাংশ বুকিং হওয়ার আশা করা হচ্ছে। হোটেল গোল্ডেন লি. ও কক্স সাইন’র এমডি মো. শাহেদ আলী বলেন, আগামী ১০-১২ জুন তিন দিন কোনো কক্ষ খালি নেই। সব রুম অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। দেশের চলমান রাজনীতি ও আবহাওয়া পরিস্থিতি ভালো হলে আশানুরূপ পর্যটক হবে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত ২১ মে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি সভায় জেলা প্রশাসন এবার চাঁদাবাজি ও নানা বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতায় কাজ করার আশ্বাস দিয়েছে।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট ক্লাব ও ট্যুরস অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (টুয়াক) সভাপতি মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ঈদুল আজহাতেও পরিচ্ছন্ন ভ্রমণপিয়াসীরা আগাম বুকিং দিচ্ছেন। তাদের লক্ষ্য পর্যটকদের শতভাগ সেবা নিশ্চিত করা।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত এসপি (ট্রাফিক) জসীমউদ্দীন চৌধুরী জানান, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পর্যটকদের সুবিধার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, কোরবানির লম্বা ছুটিতে পর্যটক নিরাপত্তায় অতিরিক্ত ফোর্স মাঠে থাকবে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনও পর্যটকদের ভ্রমণ আরামদায়ক করতে নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
রাঙামাটি প্রতিনিধি
ঈদুল আজহার ছুটিতে পাহাড় ও হ্রদে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটাতে প্রতি বছরই এখানে ছুটে আসেন হাজারো ভ্রমণপিপাসু। পবিত্র ঈদুল আজহার লম্বা ছুটি থাকায় এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে আশা করছেন হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট মালিকরা। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
ঈদের টানা ছুটিতে সাজেক ভ্যালি, ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাই লেক, পলওয়েল পার্ক, বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধিসৌধ, রাজবন বিহার, আরণ্যক ও সুবলং ঝর্ণাসহ রাঙামাটির বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র মুখর হয়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করছেন তারা। জেলার হোটেল-মোটেল মালিকরা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পর্যটক বরণে নৌবিহারের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন টুরিস্ট বোট সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও। ট্যুরিস্ট বোট চালক সমিতির নেতা রজমান আলী বলেন, আশা করছি ঈদের ছুটিতে বেশ ভালো পর্যটক সমাগম হবে। আমরা আমাদের যাবতীয় প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ করেছি।
আবাসিক হোটেল এম্ভেসাডার ম্যানেজার মো মামুন পূর্বকোণকে বলেন, এবার ঈদুল আজহার টানা ১০দিন ছুটিতে মঙ্গলবার (৩ জুন) পর্যন্ত আমাদের হোটেলের ৭০ শতাংশ বুকিং হয়ে গেছে। আশা করছি বৈরী আবহাওয়া সত্তে¡ও আশানুরূপ পর্যটক রাঙামাটি বেড়াতে আসবে।
রাঙামাটি পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা পূর্বকোণকে বলেন, এইবারে ঈদুল আজহায় লম্বা ছুটি। ইতোমধ্যে আগামী ৯-১৪ জুন পর্যন্ত আমাদের মোটেলের ৮০ ভাগ অগ্রিম বুকিং করেছে পর্যটকরা।
রাঙামাটির আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মো. মোস্তফা কামাল উদ্দিন বলেন, হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টগুলোতে ইতোমধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রুম বুকিং হয়ে গেছে।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
ঈদে পর্যটকদের বরণে প্রস্তুতি নিচ্ছে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র। হোটেল-মোটেল, পার্ক ছাড়াও বিনোদন কেন্দ্রগুলোর কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত সময় পার করছে। পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ পর্যটকদের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। খাগড়াছড়িতে প্রতিদিন-ই কমবেশি পর্যটকদের আগমন ঘটলেও ঈদে পর্যটন বা বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের সমাগম হয়ে থাকে দিগুণ।
ঈদের বাকি আর বেশিদিন নেই, তাই হোটেল-মোটেল, পার্কসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে সংস্কার ও আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্তৃপক্ষ। ঈদুল আজহাকে ঘিরে আবারও পর্যটন খাতে প্রাণ সঞ্চার হওয়ার আশা হোটেল-মোটেল ও পর্যটন কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের।
তারা জানান, ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হলে পর্যটকদের ঢল নামবে এবং খাগড়াছড়ি বিনোদন কেন্দ্রগুলো আবারও ফিরে পাবে তার চিরচেনা কোলাহল। আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র রহস্যে ঘেরা সুরঙ্গ পথ, দেবতা পুকুর, জেলা পরিষদ পার্ক, মায়াবিনী লেক, হাতির মাথা সিঁড়ি, রিসাং ঝরনাসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখন নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে। এখন আমাদের পক্ষ থেকে পর্যটকদের বরণে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ।
ই-ট্যুরিজম এসোসিয়েশন সদস্য উজ্জ্বল দে জানান, ঈদুল আজহার ছুটিতে পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে আশা করছি।
হোটেল মালিক ছালেহ আহমদ জানান, আমরা প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে আমাদের হোটেল মডেলগুলো ব্যাপকভাবে সাজিয়েছি। পর্যটকদের বরণে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ।
ট্যুরিস্ট পুলিশ জোন ইনচার্জ জাহিদুল কবির জানান, আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেহেতু এবার ঈদে বেশকিছু দিনের ছুটি আছে তাই খাগড়াছড়িতে প্রচুর পর্যটক সমাগমের আশা করা হচ্ছে বিনোদনগুলোতে। বিনোদন কেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি একটি মোবাইল টিম থাকবে।
জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার জানান, ঈদ উপলক্ষে পর্যটকদের ভ্রমণ উপভোগ্য করতে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য জেলা প্রশাসন কাজ করছে।
বান্দরবানে হোটেল মোটেলে রিসোর্টে আগাম বুকিং, বৈরী আবহাওয়ায় শঙ্কা
মিনারুল হক, বান্দরবান
কোরবানির ঈদের টানা ছুটিতে বান্দরবানের হোটেল মোটেল রিসোর্টগুলো সব আগাম বুকিং হয়ে গেছে। শুধু বান্দরবান জেলা শহরেই নয় চিম্বুক পাহাড়ের নীলগিরি, সাইরু, লাবাতংসহ বিভিন্ন রিসোর্টগুলো ৮০ শতাংশ বুকিং হয়ে গেছে। তবে টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে ছুটির আনন্দ নিরানন্দে রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে লোকজন বেড়াতে আসে বান্দরবানে।
বর্ষার এই সময়ের সবুজ প্রকৃতি, মেঘে ঢাকা আকাশ, বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি সেই সাথে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ছুট চলা নদী ঝর্ণা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। বান্দরবানের নীলাচল, মেঘলা, প্রান্তিক লেক, শৈলপ্রপাত, নীলগিরি, চিম্বুক, থানচির তমাতুঙ্গি, ডিম পাহাড়, বড় পাথর রোয়াংছড়ির দেবতা খুমে পর্যটকরা ঘুরে বেড়ান।
বান্দরবান হোটেল মোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে বান্দরবানের হোটেল মোটেল রিসোর্ট সব আগাম বুকিং হয়ে গেছে। শহর ও আশেপাশের এলাকায় রয়েছে শতাধিক হোটেল মোটেল রিসোর্ট। এসব জায়গায় কয়েক হাজার পর্যটক থাকতে পারে। অন্যদিকে থানচি ও লামা আলী কদমেও গড়ে উঠেছে নতুন নতুন রিসোর্ট। তবে বৈরী আবহাওয়া পর্যটকদের আনন্দে বাদ সাধতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। ইতিমধ্যে পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কায় লামা উপজেলার মিরিঞ্জা এলাকার অনেক পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এছাড়া সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে যারা রুমা উপজেলায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে পর্যটক যাতায়াতে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞ রয়েছে।
তবে অনেক জায়গা থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর বান্দরবানে পর্যটকদের আগমন অনেক বেড়েছে। সামনের ঈদেও প্রচুর সংখ্যক পর্যটক ভালোভাবে বেড়াতে আসবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
পূর্বকোণ/ইবনুর