চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

সর্বশেষ:

চীন-বাংলাদেশ

বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল

অর্থনৈতিক রূপান্তরের দুয়ার নাকি সতর্কতামূলক উপাখ্যান?

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

২ জুন, ২০২৫ | ৮:০২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ একটি উচ্চপর্যায়ের চীনা বিনিয়োগ প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানিয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা ১০০’রও বেশি। এই ঘটনাটি দেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এমন এক সময়ে, যখন বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা পরিবর্তনের মুখে এবং বিনিয়োগ প্রতিযোগিতা তীব্রতর হচ্ছে, তখন এই সফর বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাব্য মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মূল প্রশ্ন হলো- এই সুযোগটি কি টেকসই প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হবে, নাকি ঋণনির্ভরতা ও ভ‚রাজনৈতিক জটিলতার দিকে নিয়ে যাবে?

চীনা বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত?
চীনের বৈদেশিক অর্থনৈতিক কৌশল এখন অনেকটাই তার ২০১৩ সালে চালু করা বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্প উন্নয়ন ও কৌশলগত অংশীদারত্বের মাধ্যমে চীন এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় তার প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলাদেশের জন্য এই সফর চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। ইতোমধ্যেই চীন বিআরআই’র আওতায় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পায়রাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে।
তবে এত বড় ও বহুমুখী প্রতিনিধিদলের উপস্থিতি শুধু অবকাঠামো নয়, বরং একটি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়, যা উৎপাদন খাত স্থানান্তর, ডিজিটাল অর্থনীতি সম্প্রসারণ, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের ওপর জোর দেয়। এটি চীনের সাম্প্রতিক কৌশলের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে শ্রমঘন শিল্পগুলোকে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং ইথিওপিয়ার মতো দেশে স্থানান্তর করা হচ্ছে দেশীয় মজুরি বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে।

অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
বাংলাদেশের সামনে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলো বুঝতে হলে অনুরূপ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীনা বিনিয়োগ কীভাবে কাজ করেছে তা দেখা জরুরি।

ইথিওপিয়া: একসময় আফ্রিকার উন্নয়ন মডেল হিসেবে বিবেচিত ইথিওপিয়া চীনের বড় বিনিয়োগ পেয়েছিল শিল্পপার্ক, সড়ক ও রেলপথে। আদ্দিস আবাবার নিকটস্থ ইস্টার্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং দেশের উৎপাদন খাতে গতি আনে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি ও ঋণ-সংক্রান্ত উদ্বেগ টেকসই উন্নয়নের প্রশ্ন তোলে।

শ্রীলঙ্কা: হাম্বানটোটা বন্দরের প্রকল্প, যা চীনা ঋণে নির্মিত, ঋণ ক‚টনীতির এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে শ্রীলঙ্কা ৯৯ বছরের জন্য এই বন্দর চীনা কোম্পানির কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়। আজও বন্দরটি অনেকটাই অনাবশ্যক এবং অপরিষ্কার চুক্তির একটি সতর্কবার্তা হয়ে আছে।

ভিয়েতনাম: তুলনামূলকভাবে সফল একটি মডেল, যেখানে চীনা বিনিয়োগকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগও আকৃষ্ট করা হয়েছে। মূল্য সংযোজিত উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়ে চীনা পুঁজির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশের কৌশলগত করণীয়

বাংলাদেশের জন্য এই সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, তবে তা কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করতে হবে।

নির্ভরতা নয়, বৈচিত্র্য: চীনা বিনিয়োগকে স্বাগত জানালেও বাংলাদেশকে অন্যান্য উৎস থেকেও পুঁজি সংগ্রহে সচেষ্ট হতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভ‚রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এটি জরুরি।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: বিনিয়োগ চুক্তিগুলো স্পষ্ট শর্তাবলীতে, পরিবেশগত মূল্যায়নসহ এবং জনসম্মুখে আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে প্রকল্প বিলম্ব বা বদনামের আশঙ্কা কমে।

মূল্য শৃঙ্খলে সংযুক্তি: কেবল অবকাঠামোর ওপর নয়, বরং প্রযুক্তি স্থানান্তর, দক্ষতা উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে (বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে) অন্তর্ভুক্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

টেকসই অর্থায়ন: শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে ঋণের টেকসইতা নিশ্চিত করতে হবে এবং শুধুমাত্র প্রতিপত্তি বাড়ানোর প্রকল্প নয়, প্রকৃত আর্থিক লাভদায়ক প্রকল্পে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

উপসংহার
চীনা বিনিয়োগ প্রতিনিধিদলের আগমন নিছক ক‚টনৈতিক সৌজন্য নয়, এটি একটি স্পষ্ট বার্তা যে, বাংলাদেশ এখন আঞ্চলিক শিল্প পুনর্বিন্যাসের কেন্দ্রে আসছে। যদি সুচিন্তিতভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে এই সম্পৃক্ততা বাংলাদেশকে ২১ শতকের এশীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খেলোয়াড়ে পরিণত করতে পারে। অন্যথায় এটি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই ঝুঁকির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। পথটি নির্ভর করছে বাস্তববাদী আলোচনার, কৌশলগত বৈচিত্র্যের এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থে অবিচল থাকার ওপর।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট