সবাই একসাথে ব্যাংক থেকে টাকা না তুলে যেটুকু না তুললেই নয় সেটুকুই তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে গ্রাহকদের উদ্দেশে সতর্ক ও সহনশীল হওয়ার পরামর্শমূলক বার্তা দেন গভর্নর।
দুর্বল ও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহক টাকা তুলতে গিয়ে চাহিদামতো টাকা তো পাচ্ছেনই না, উপরন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া ৪ লাখের উত্তোলন সীমার টাকাও দিতে পারছে না তারা। কোনো ব্যাংকের বুথে গেলে টাকা নেই, কারও অনলাইন লেনদেন বন্ধ, যে ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট সেখানে গিয়ে টাকা তোলার মতো ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে পড়া শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ আসছে, গচ্ছিত টাকা নিয়ে উদ্বেগেও রয়েছেন তারা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়- এমন প্রশ্নে গভর্নর মনসুর বলেন, পৃথিবীর যে কোনো দেশের ব্যাংকে সব গ্রাহক যদি একসাথে টাকা তুলতে যায়, তাইলে ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা দিতে পারবে না। “তাই গ্রাহকদের বলব ধৈর্য ধরার জন্য। একসাথে টাকা তুলতে যাবেন না। তাইলে টাকা পাবেন না।”
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকের শীর্ষ পদ থেকে আব্দুর রউফকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে আহসান মনসুরকে বসায়। নিয়োগ পাওয়ার এক সপ্তাহ পর ২০ অগাস্ট ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় গভর্নর মনসুর ব্যাংক থেকে আমানত তোলাকে আমানতকারীর ‘সার্বভৌম অধিকার’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, “নিরাপদ বোধ না করলে টাকা তুলে নেবেন গ্রাহক। সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না সরকার।” তবে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখার পেছনে অনেক গ্রাহকের মধ্যে ‘অতিরিক্ত সুদের লোভ’কে চিহ্নিত করেছেন গভর্নর মনসুর।
তিনি বলেন, “এসব ব্যাংকে অনেকে অতিরিক্ত সুদের লোভে টাকা রেখেছেন। ব্যাংকগুলো এমনিতেই ভালনারেবল ছিল। তাই এটা ভালো হয়েছে নাকি ক্ষতি হয়েছে, তা বলব না। আমরা এখন চেষ্টা করব ব্যাংকগুলোকে সবল করার জন্য। “তবে এসব ব্যাংক ঠিক করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হবে না। টাকা ছাপিয়ে ব্যাংককে সহায়তা করার প্রক্রিয়া অনেক সহজ। তারপর দেখা যাবে মূল্যস্ফীতি ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।” ২০ অগাস্টও এমনটি বলেছিলেন গভর্নর।
তবে বিদ্যমান সংকটকালীন মুহূর্তে আমানতকারীদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, আমানতকারীদের টাকার ক্ষতি হোক আমরা চাই না। এসব দুর্বল ব্যাংক, তা আগে আপনারা জেনেছেন; তারপরও টাকা রেখেছেন। “তাই এখন ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে তাদের দেওয়া হবে; তা করা হবে না। কারণ এটা জাতির জন্য ভালো হবে না। কারণ তা কিছু আমানতকারীর জন্য ভালো হলেও পুরো দেশ ও এক্সচেঞ্জ রেটও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে “ ধৈর্য ধরলে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি ঠিক হবে বলে আশা দেখিয়ে গভর্নর বলেন,“আমি বলব না ব্যাংক খাতের ওপর এখনই আস্থা রাখতে হবে। আস্থা থাকুক আর না থাকুক ধৈর্য ধরতে হবে। সবাই মিলে টাকা উত্তোলন করতে যাবেন না। যেটুকু না তুললেই নয় সেটুকুই টাকা তুলুন। ছয় মাস কিংবা এক বছর পর আস্তে আস্তে দেখি স্বাভাবিক হয় কি না। আস্তে আস্তে ঠিক হবে। সেটার জন্য সময় দিতে হবে “ শরিয়াভিত্তিক ছয় থেকে আটটি ব্যাংকের অবস্থা বেশ খারাপ। বছরদুয়েক আগে থেকেই এসব ব্যাংক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কয়েকটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার সতর্ক করেছে, ‘দুর্বল’ ও ‘লাল’ চিহ্নিত করে তাদের টেনে তুলতে টাকা ছাপিয়ে সরবরাহ করেছে বলেও খবর রয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এসব ব্যাংকের বেশিরভাগের মালিক, যার মধ্যে অন্যতম এস আলম গ্রুপ। আহসান মনসুর গর্ভনের দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্যষদ অর্থাৎ মালিকায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর করেন, “ছয়টি ব্যাংকের বোর্ড ইতোমধ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে। সামনে আরও কয়েকটি ব্যাংকের করা লাগতে পারে। খুব দ্রুতই করা হবে। পুরনো বোর্ড দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যাচ্ছিল না, তাই বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে “ “এখন ব্যাংকগুলো কীভাবে রিস্ট্রাকচার করা হবে এটা আমাদের পরবর্তী কাজ; কোন মডেলে কাজ করা হবে এবং কাদের কাছ থেকে আমরা সহযোগিতা চাইতে পারি।” এ খাতকে ঠিক করার জন্য বিদেশ থেকে সাহায্য চাওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, তা ছাড়া দেশেই অনেক যোগ্য লোকের পরামর্শ নেওয়া হবে।
ব্যাংকিং কমিশন কিংবা টাস্কফোর্স যাই গঠন করা হোক না কেন বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সক্রিয় থাকবে বলে বার্তা দিয়ে গভর্নর বলেন, “আগের কমিশনের ন্যায় এটা হবে না।” আইন সংশোধন করে গভর্নর পদে বসানো ৭২ বছর বয়সি আহসান মনসুর বলেন, “ব্যাংক খাতকে সংস্কার করতে হবে। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কাজ হবে এবার। তা এই সংস্কারের জন্য সময়ও লাগবে। এটা ৩ মাস কিংবা ৬ মাসের কাজ নয় যে, একটা রিপোর্ট জমা দিয়ে কাজ শেষ। মাস খানেকের মধ্যে এ নিয়ে একটা পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” এখন কার্যপ্রনালি ঠিক করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, সামনে বিষয়টি ঠিক করা হবে। এস আলমের ব্যাংক ঋণ শোনা যাচ্ছে দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে- এমন তথ্য তুলে ধরে এক সাংবাদিক জানতে চান এটা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারি কিনা। জবাবে আহসান মনসুর বলেন, “আমার জানা মতে আর নাই। দুই-একটা খুঁজে দেখতে হবে আর আছে কি না। কুয়েত ইনভেশনের সময় তখন ফান্ডের টাকা এদিক-সেদিক হয়ে গেছে। রাষ্টযন্ত্রকে ব্যবহার করে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করার এমন ঘটনা আমি কোথাও শুনি নাই।”
এ সময় ইসলামী ব্যাংক পুনর্গঠনের বিষয়ে এক প্রশ্নে গভর্নর বলেন, “ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে কাজ করবে। এখানে একমাত্র আমানতকারীদের স্বার্থ জড়িত। বোর্ড দেওয়া হয়েছে। দরকার হলে বোর্ড পরিবর্তন করা হবে। প্রতেকেই যদি দায়িত্ব নিয় কাজ করে। আমরা তাদের সকল রকম আইনি সহায়তা দেব। “তারা যদি সহ¬¬¬¬য়ক ভূমিকা পালন না করে, তাহলে বোর্ড পরিবর্তন করা হবে। তাদের মনে রাখতে হবে তারা সরকারের প্রতিনিধি। তারা জনগণের জন্য নির্মোহভাবে কাজ করবে। ব্যাংক ও আমানতকারীদের সার্থের জন্য তারা যদি কাজ না করেন; কোনো ধরনের ম্যালপ্রাক্টিস (অসাদাচার) হলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না “ – বিডিনিউজ
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ