বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন হয়। এই একটি বন্দরের ওপর অতিনির্ভরতার কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি হলেই বন্দরে পণ্য পরিবহনের চাপ বাড়াটা স্বাভাবিক। ছুটির সময় এই চাপ আরও বাড়ে, যাতে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। প্রতিবছর আমরা নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শুনি। কিন্তু কার্যত বন্দর ছাড়া অন্য কোন সংস্থা সক্রিয় হতে দেখি না। ফলে চাপ কমে না। বন্দরের ওপর চাপ বাড়লে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের গতি কমে যায়। জাহাজের গড় অবস্থান বেড়ে যায়। পণ্য হাতে পেতে দেরি হয়। এ থেকে বেরিয়ে আসতে প্রতিবছর ঈদের ছুটির সময় বন্দর কিছু নির্দেশনা জারি করে। সেই নির্দেশনায় সব সংস্থা সেভাবে সাড়া দেয় না। তাতে জট কমে না।
এখানে জানিয়ে রাখা দরকার, বন্দরের কার্যক্রম পুরোদমে সচল থাকবে কিনা তা নির্ভর করে সব সংস্থার সক্রিয়তার ওপর। বন্দরের পরিচালন কার্যক্রম সপ্তাহের ২৪ ঘণ্টা সচল থাকে। শুধু ঈদের দিন এক পালার কাজ বন্ধ থাকে। বন্দরের কার্যক্রম সচল থাকলেও সুফল পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ বন্দর শুধু পণ্য ওঠানো-নামানো ও সংরক্ষণ করে। খালাসের জন্য পণ্যের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া করে কাস্টমস। আবার কাস্টমস পণ্যের শুল্কায়ন করতে হলে অনেকগুলো সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। যেসব পণ্য ল্যাবে পরীক্ষা হবে সেগুলোর জন্য বিএসটিআই, উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রসহ অনেকগুলো সংস্থার পরীক্ষার রিপোর্ট দরকার হয়। আবার ব্যাংকও খোলা থাকতে হয়। আমদানিকারকেরও পণ্য খালাস করতে হয়। নাহলে বন্দর খোলা থাকলেও সুফল মিলবে না।
আমরা প্রতিবার দেখি, ঈদের ছুটির পর পর বন্দরে কনটেইনার জমে যায়। জেটিতে ভেড়ানোর অপেক্ষায় সাগরে জাহাজের জট দেখা দেয়। এবার একটু ব্যতিক্রম। কারণ ১৪ মে থেকে এনবিআর বিলুপ্তির প্রতিবাদে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শুল্কায়ন, পরীক্ষাসহ সবধরনের কাস্টমস কার্যক্রমে কলমবিরতিসহ পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করেন। এই কর্মবিরতির আগে-পরে পরিবহন শ্রমিকদের কয়েক দফা আন্দোলনের কারণে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোও বন্ধ ছিল। ফলে ছুটির আগে থেকেই বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনারের জট শুরু হয়। জট চলার সময় ঈদুল আজহা উপলক্ষে টানা ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ছুটি শুরু হচ্ছে আগামী ৫ জুন থেকে, যা শেষ হবে ১৪ জুন। এর আগে গত ঈদুল ফিতরে নয়দিন ছুটি পেয়েছিলেন সরকারি চাকরিজীবীরা। এই টানা ছুটিতে কীভাবে কাজ হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়ে গেছে।
ছুটির সময় বন্দরে শুধু এক পালা বা আট ঘণ্টার কাজ বন্ধ থাকবে। বাকি সময় বন্দরের পরিচালন কার্যক্রম খোলা থাকবে। কিন্তু এ সময় কাস্টমস কার্যক্রম সীমিত থাকবে। অন্য সংস্থাগুলো থেকে যে সেবা পাওয়া যাবে তাও নিশ্চিত নয়। শিপিং এজেন্ট থেকে ডেলিভারি অর্ডার নিতে হবে। যদি তাদের অফিস খোলা না থাকে তাহলে একটির জন্য পণ্য খালাস আটকে যাবে। আবার এ সময় মহাসড়কে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কারখানাগুলোতে ছুটি দেওয়া হয়। আমদানিকারকের পক্ষে নিয়োজিত সিএন্ডএফ কর্মীরাও ছুটিতে চলে যায়। অর্থাৎ, কোন আমদানিকারক চাইলেও অনেকক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণে এ সময় পণ্য খালাস সম্ভব হয় না। মোটাদাগে ব্যাংক, কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ি, পণ্যবাহী যান, গার্মেন্টস ওয়্যারহাউজ, কাস্টমস ক্লিয়ারিং, শিপিং লাইন ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারসহ সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সচল না থাকলে কাজ হবে না।
ছুটির সময় বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু কাস্টমসের জনবলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত না থাকলে পণ্য খালাসে সুফল মিলবে না। আমরা আশা করবো, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ছুটির সময় উল্লেখযোগ্য জনবল যেন প্রস্তুত রাখে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিজিএমইএ ছাড়া অন্য আমদানি কনটেইনার পণ্য ডিপোতে নিয়ে খালাসের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। কাস্টমসের নির্দেশনা এলে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে।
বন্দরের ভেতরে যদি কনটেইনার খুলে পণ্য খালাস না হতো তাহলে বন্দরের এত মাথাব্যথা হতো না। বন্দর নিজের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারতো। এখন বন্দরে ৬০ শতাংশ কনটেইনার পণ্য খুলে খালাস নেওয়া হয়। এতে এক কনটেইনার পণ্যের জন্য দুটি ট্রাক বন্দরে ঢোকাতে হয়। ফলে বন্দরের ইয়ার্ডেও গাড়ির ব্যস্ততা বেশি থাকে, যা অপারেশনে বিঘ্ন ঘটায়।
বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে চারটি কনটেইনারবাহী জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করছে। প্রতিটি জাহাজে গড়ে এক হাজার কনটেইনার থাকায় প্রতিদিনই চার হাজার নতুন কনটেইনার সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। এখনই ৩৮-৩৯ হাজার কনটেইনার রয়েছে বন্দরের ভেতরে। ধারণক্ষমতা সাড়ে ৫৩ হাজার কনটেইনার। ছুটি শুরুর পর যখন খালাস কমবে তখন এই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়বে।
এই সংকট থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস, ব্যাংক, আমদানিকারক, শিপিং এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, আইসিডি অপারেটর ও কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে বাস্তবমুখী, সময়োপযোগী ও কার্যকর সংলাপ ছাড়া এই জট কাটানো সম্ভব নয়।
কারণ এই সংকট শুধু একটি লজিস্টিক সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এই হৃৎপিণ্ডে রক্তসঞ্চালন ব্যাহত হলে গোটা অর্থনীতিই ধাক্কা খাবে। তাই সময় থাকতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াই এখন সবচেয়ে জরুরি; নাহলে পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।
লেখক: সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এসোসিয়েশন (বাফা) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন।
পূর্বকোণ/ইবনুর