চন্দনাইশের দোহাজারী এলাকার চাকরিজীবী তোবারক হোসেন ও গৃহিণী জাহানারা বেগমের সন্তান মোহাম্মদ মুনতাসিন আফতাহী। ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর অনেকটা প্রি-ম্যাচিউর অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। সে মায়ের গর্ভে ছিল মাত্র ৭ মাস তিন দিন। তাই বাড়িতে জন্মের পরপরই সে নীল বর্ণ ধারণ করে। শুরু হয় খিঁচুনি। ফেনা চলে আসে মুখে। তাৎক্ষণিক তাকে দোহাজারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন চিকিৎসা শেষে বাড়িতে আসার পর পুনরায় তার শরীরে জ্বর চলে আসে। আবারো তাকে নিয়ে আসা হয় দোহাজারী হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এভাবে কয়েক মাসে একাধিকবার হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর পরও মুনতাসিন আফতাহীর শরীরে স্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এর মধ্যে ৯ মাস বয়সে তার নিউমোনিয়াও হয়। এরপর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মা-বাবা লক্ষ্য করলেন যে, মুনতাসিন আফতাহী অন্যান্য বাচ্চাদের মত স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে না। তাতে তার চাকরিজীবী বাবা ও গৃহিণী মা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে মুনতাসিন আফতাহীকে চিকিৎসা করালেও শরীরে তেমন কোন উন্নতি না হওয়ায় খুবই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তার মা-বাবা। অবশেষে নানাভাবে খবর পেয়ে ২০১৬ সালে তারা মুনতাসিন আফতাহীকে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত কনসালট্যান্ট (ফিজিওথেরাপি) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মুনতাসিন আফতাহী’র ‘সেরিব্রালপালসি’ রোগ চিহ্নিত করেন।
মুনতাসিন আফতাহী’র রোগের লক্ষণগুলো হলো ঘাড় নুয়ে পড়া, মাংসপেশীর শক্তি কম, দাঁড়াতে ও হাঁটতে পারে না, নিজের কাজ নিজে করতে পারে না, লালা পড়ে, কোন কিছু সহজে বুঝতে ও কথা বলতে পারে না ইত্যাদি। এ অবস্থায় চিকিৎসক মুনতাসিন আফতাহীকে একটি চিকিৎসা পরিকল্পনা দেন এবং সে অনুযায়ী তাকে নিয়মিত সেবা কেন্দ্রে এসে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপী চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেই সাথে বাবা-মায়ের মানসিক চিন্তা দূর এবং মুনতাসিন আফতাহীকে সঠিক ভাবে পরিচর্চার জন্য তাদেরকে কাউন্সেলিং করেন। ফিজিওথেরাপিতে মুনতাসিন আফতাহীকে ঘাড়ের এক্সারসাইজ, স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ, ব্যালেন্সিং এক্সারসাইজ ইত্যাদি চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা দেওয়া হয়। একই সাথে অকুপেশনাল থেরাপিতে তাকে গ্রস মটর, ফাইন মটর এক্টিভিটিস, এডিএল প্রাকটিস ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিতে মুনতাসিন আফতাহী’র যোগাযোগ দক্ষতা, ভাবের আদান-প্রদান, লালা পড়া এবং ভাষাগত সমস্যা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা পেয়ে মুনতাসিন আফতাহী এখন হাঁটতে পারে; বলতে পারে স্বাভাবিক কথাবার্তাও। চালাতে পারে বাই সাইকেলও। ১৪ বছর বয়সী মুনতাসিন আফতাহী লেখাপড়া করছে স্থানীয় একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে। পাশাপাশি দাবাও খেলে সে। বলা যায় সে এখন অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে।
মোহাম্মদ মুনতাসিন আফতাহী’র মা জাহানারা বেগম সন্তানের চিকিৎসা প্রসঙ্গে দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের চিকিৎসায় তার সন্তান আল্লাহর রহমতে এখন অনেকটা সুস্থ। সে এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়াও। সন্তানের চিকিৎসার জন্য আমি চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
মুনতাসিন আফতাহী’র মতো চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছে আরেক প্রতিবন্ধী সাকশি দাশ (১২)। সে নগরীর পাথরঘাটা এলাকার বাসিন্দা শাকিল দাশ ও স্মৃতি দাশের কন্যা। সাকশি দাশের অসুস্থতা ও চিকিৎসাশেষে তার সুস্থ হয়ে ওঠার আদ্যপান্ত জানালেন তার মা স্মৃতি দাশ। দৈনিক পূর্বকোণকে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের ১৮ মে সাকশি দাশের জন্ম। এরপর তার নিউমোনিয়া হয়। কিছুদিন পর তার খিঁচুনি দেখা দেয়। তখন যথাসম্ভব চিকিৎসাও করা হয়। এভাবে নানা রোগের সমস্যা নিয়ে সাকশি দাশের দিন অতিবাহিত হতে থাকে। ৬ বছর বয়সে তাকে যখন স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যাই, তার কিছু লক্ষণ দেখে শিক্ষকেরা তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পরামর্শ দেন। ওই সময় সাকশি দাশের আচরণ স্বাভাবিক ছিল না; কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে অনেকটা অস্থির প্রকৃতি হয়ে ওঠে। মানুষকে সজোরে কামড় দিতো। দেওয়ালে মাথা টোকাতো, ঘর থেকে বের হয়ে যেত; স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতো না। এমন কি পরনের জামা-কাপড়ও খুলে ফেলতো। নিরুপায় হয়ে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতাম। এ অবস্থায় স্থানীয় একজনের কাছে খবর পেয়ে তাকে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে নিয়ে আসি। সেখানে চিকিৎসকেরা সাকশি দাশের ‘অটিজম’ সমস্যা চিহ্নিত করেন। একইসাথে সেখানে নিয়মিত ৯ বছর বয়স পর্যন্ত তার চিকিৎসা চলে। তাতে রোগের আর কোনো সমস্যা তার মধ্যে বিদ্যামান নেই। এখন সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। বর্তমানে সাকশি দাশ স্থানীয় একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
শুধু মুনতাসিন আফতাহী, সাকশি দাশ নয়, চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের নিয়মিত ফ্রি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন অসংখ্য প্রতিবন্ধী ও সাধারণ মানুষ। এখানে প্রতিবন্ধী রোগীদের ফিজিওথেরাপি, অকুপেশানাল থেরাপি, স্পিচ এন্ড লেঙ্গুয়েজ থেরাপি দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিবন্ধীসহ সব ধরনের রোগীর জন্য বাত ব্যথা, প্যারালাইসিস, মেরুদন্ডের ব্যথা, ঘাড়, কাঁধ, কোমর ও হাঁটু ব্যথা, আঘাত জনিত ব্যথা, হাত-পা অবশ ও শুকিয়ে যাওয়া, মুখ বেঁকে যাওয়া, মাংসপেশীর ব্যথার থেরাপি দেওয়া হয়। তাছাড়া অটিজম সংক্রান্ত সেবা, অটিস্টিক বিদ্যালয়, সহায়ক উপকরণ বিতরণ (হুইল চেয়ার, সাদাছড়ি, হিয়ারিং এইড, ট্রাইসাইকেল ইত্যাদি), অভিভাবক প্রশিক্ষণ, কাউন্সেলিং সেবা এবং মোবাইল থেরাপি ভ্যান সার্ভিস দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে নগরীর হালিশহরে একটি ভাড়া করা ভবনে। সেখানে টানা তিন বছর চিকিৎসা সেবা প্রদানের পর ২০২১ সালে এটি স্থানান্তর হয় নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার এ- ব্লকের তিন নম্বর রোডের একটি ভবনে। পরবর্তীতে ২০২২ সালে এটি নগরীর মুরাদপুর মোড় সংলগ্ন জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স ভবনে নিজস্ব কার্যালয়ে চলে আসে। এ ভবনের নিচতলায় ৪ বেডে প্রতিদিন সেবার কার্যক্রম চলে আসছে। প্রতিদিন এ কেন্দ্রে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে।
চিকিৎসা সেবা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের কনসালটেন্ট ফিজিওথেরাপি ডা. শামীমা নাসরীন দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন পরিচালিত চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী ও সাধারণ রোগীদের বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়। বিশেষ করে এখানে চিকিৎসা সেবা নিয়ে অসংখ্য প্রতিবন্ধী ভাল হয়েছে। তাছাড়া এখানে বিনামূল্যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা রয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা সিতারাই ফেরদৌস দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, এখানে প্রতিবন্ধী ছাড়াও যে রোগীর জন্য বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি সেবা দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে এটি ছাড়া আরো একটি সেবা কেন্দ্র রয়েছে রাঙ্গুনিয়াতে। সাধারণত প্রতিবন্ধী রোগীর পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল থাকে তুলনামূলক বেশি। এ কারণে দূর-দুরান্তের প্রতিবন্ধী রোগীরা সহজে এখানে এসে চিকিৎসা নিতে পারে না। তাই প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের সেবা কেন্দ্র চালু হলে প্রতিবন্ধী রোগীদের অনেক কষ্ট লাঘব হবে।
পূর্বকোণ/ইবনুর