বিভিন্ন সময়ে নানা সরকারি সেবার মাসুল বৃদ্ধি পেলেও প্রায় চার যুগ ধরে পুরোনো একই ট্যারিফে চলছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালের নির্ধারণ করা ট্যারিফ দিয়েই প্রায় ৫০ ধরনের সেবা মাসুল আদায় করে চলছে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান কার্যক্রম। যদিও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৫টি সেবার মাসুলে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের চাহিদা ও ব্যয়ের সঙ্গে এই পুরোনো ট্যারিফ কাঠামো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই নতুন ট্যারিফ নির্ধারণে আজ মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক বসছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে আজ সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরসহ সরকারি বেসরকারি প্রায় ২৮টি সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের এই প্রধানতম স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা হবে। এর আগে ২০১৩ সাল থেকেই বন্দর ট্যারিফ পুননির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সেই সময় সরকারের অনাগ্রহে তা স্থগিত হয়ে যায়। পরে ২০১৯ সালে আবার এই কার্যক্রম শুরু হয়। যার প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আইডম কনসাল্টিং, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড আর্কিটেকচার এবং বাংলাদেশের লগিকফোরাম লিমিটেডকে ট্যারিফ কাঠামো পর্যালোচনা ও নতুন প্রস্তাবনা তৈরির জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ট্যারিফ কাঠামো হালনাগাদ করা, ব্যবহারকারীদের জন্য ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক শুল্ক নির্ধারণ করা, বন্দরের রাজস্ব আয় ও সেবার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করার বিষয় বিবেচনায় রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ ট্যারিফ প্রস্তাব করেছে। চূড়ান্ত প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে, যার আলোকে এখন মন্ত্রণালয় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আজ সভায় বসবে।
এদিকে, নতুন প্রস্তাবে বিভিন্ন সেবার ট্যারিফ ৭০% থেকে ১০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যেমন ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ ১৫ ডলার থেকে ২৩ দশমিক ১৫ ডলার এবং ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য সাড়ে ২২ ডলার থেকে ৩৪ দশমিক ৮৩ ডলার করা হতে পারে। এছাড়া, জাহাজের পাইলটিং চার্জ ৩৫৭ ডলার থেকে বৃদ্ধি করে ৭শ ডলার করা হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে উল্লেখ বলা হয়- নতুন ট্যারিফ প্রস্তাবে বন্দরে প্রবেশ ফি, পাইলটেজ চার্জ, লোডিং ও আনলোডিং চার্জসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফি’র হার প্রায় অর্ধেক থেকে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ১৮ হাজার টনেজ ধারণক্ষমতার একটি জাহাজের বন্দরে প্রবেশ ফি বর্তমানে ৪ হাজার ৩৬২ ডলার। এটি বাড়িয়ে ৬ হাজার ৮৩৪ ডলার নির্ধারণ করার প্রস্তাব এসেছে। এক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। একইভাবে, পাইলটেজ চার্জের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৬ শতাংশ এবং লোডিং/আনলোডিং চার্জের ক্ষেত্রে ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বাড়তি খরচ শিপিং এজেন্ট ও ব্যবসায়ীদের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশন।
ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে বন্দরকে দেয়া পত্রে শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন উল্লেখ করে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বর্তমান সময়েও একচেটিয়া বাজারের মধ্যেই কাজ করছে, যেখানে বন্দরের সুবিধা, অবকাঠামো, কর্মদক্ষতা ও আন্তর্জাতিক মানের সেবা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় চার্জ বৃদ্ধি যৌক্তিক নয় এবং এটি দেশের লজিস্টিক ও ট্রেড ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার সুযোগ কমিয়ে দেবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পোর্ট সার্ভিস চার্জ ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য বন্দরের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় এই নতুন হারে ব্যবসায়ীরা সংকটের মুখে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল বলেন, একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে জিডিপি বৃদ্ধি, রেল ও সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন, পোর্ট আধুনিকায়নসহ মৌলিক ভৌত অবকাঠামো এখনো ব্যাপক উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে ট্যারিফ বাড়ানো ব্যবসাবান্ধব নয়। এটা ব্যবসার পরিবেশকে আরও কঠিন করবে এবং দেশের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে।
পূর্বকোণ/ইবনুর